করোনার জের – ফিরিয়ে দিল ৬১ বছর আগের জ্বলন্ত স্মৃতি

Souris  Dey

Souris Dey

বিজ্ঞাপন
ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: লাইনটা দীর্ঘ থেকে ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। সামনে থেকে হাঁক আসছে পা চালাও। পিছনে সারি সারি পা এগিয়ে চলেছে। কত কুন্তি,কত থিরুমল সেই সারিতে পা মিলিয়ে চলছেন। এই দৃশ্য যেন ২০২০-র করোনা পরিস্থিতিতে স্মৃতিচারণা। এই অবস্থাই যেন ফিরিয়ে দিল নয়নয় করেও কাউকে ১০০ বছর আগের স্মৃতি, আবার কাউকে ৬১ বছর আগে তৈরী মরুতীর্থ হিংলাজ সিনেমার জ্বলন্ত ছবি। 
চড়াই উতরাই, প্রতি মূহূর্তে বিপদকে পাশে রেখেই চলেছেন হিংলাজ দর্শনে। মাইলের পর মাইল হাঁটা। পথে কত অজানা ভয়, তবুও চলেছেন তাঁরা। লক্ষ্য স্থির। পৌঁছাতেই হবে গন্তব্যে। একটা ভাইরাসের আতংকে গোটা দেশ জুড়ে চলছে লক ডাউন, তার ফলে তৈরী হয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। ভিন রাজ্যে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার কোনো সুযোগ ছিল না এতদিন। আর আজ যখন তারা সুযোগ পেয়েছেন তখন নেই কোনো যানবাহন। 
হিংলাজ দর্শনের মতই বাড়ির পরিজনদের কাছে পেতে, নিজের বাড়িতে ফিরতে পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে, বৈশাখের দাবদাহ, ঝড় আর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তারা এগিয়ে চলেছেন দূর-দূরান্তে, তাঁদের গন্তব্যে। এঁদেরই একাংশ চলেছেন দামোদর নদের বাঁধ ধরে, পায়ে হেঁটে। তারা কেউ যাচ্ছেন বিহার, কেউ ঝাড়খন্ড, কেউ যাচ্ছেন মুর্শিদাবাদ, আবার কেউ ছত্রিশগড়। লাল সুড়কির উপর দিয়ে কেউ যাচ্ছেন খালি পায়ে হেঁটে, পরনের পোশাক জীর্ণ, চোখে মুখে গভীর ক্লান্তির ছাপ। 
কোনো দলে ১০জন, কোনো দলে ২০জন আবার কোনো দলে তারও বেশি। কবে শেষ ভাত খেয়েছেন ভুলে গেছেন নিজেরাই। শ্রান্ত শরীর -তাতে কি, লক্ষ্য একটাই বাড়ি ফিরতে হবে। হাতে নেই কোনো অর্থ। ইতিমধ্যেই যার যতটুকু ছিল তাও পথ চলতে চলতে শেষ। ভরসা একটাই মনের জোর। খিদে, তেষ্টায় রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গেলেও কিছু করার নেই। বনপথ, জলপথ কোনো কিছুই দেখার সময় নেই। কেবল অনন্ত রাস্তা ধরে হেঁটে চলাই যেন এখন জীবন। 
কিন্তু সিনেমার কাহিনীর সঙ্গে বাস্তবের ৬১ বছরের পরের জীবন – মানষিকতার ঢের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সময় নিজেকে বাঁচাতে অপরকে হত্যা করার মত ঘটনা ঘটলেও এখন তার উল্টো ছবি। এখন নিজে যেমন বাঁচো, অপরকেও বাঁচার সুযোগ করে দাও। কাজ হারিয়ে, মনে ভেঙে যে দিনমজুর পরিযায়ী শ্রমিকরা অসহায় হয়ে বাড়ি ফিরছেন, সেই অসহায়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারী ১ব্লকের দলুইবাজার ২গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পশ্চিমপাল্লার শ্রমজীবী মানুষজন। 
নিজেরাই দিনমজুর। করোনার কৃপায় তাঁদেরই কাজ নেই দীর্ঘদিন। নিজেদের সংসার কিভাবে চালাবেন তাই বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু গ্রামের দূর দিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ যখন দামোদরের বাঁধের লাল সুড়কির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন ন্যুব্জ দেহে, তখন তাঁরা আর চুপ করে থাকতে পারেননি। দিনমজুরের অন্তরও দুলে উঠেছে। 
আর তাই গত ৫দিন ধরেই তাঁরা এক নতুন উৎসাহে শুরু করেছেন মানুষ সেবা। নিজেদের উজাড় করা সামর্থ্য নিয়ে। পশ্চিমপাল্লার গ্ৰাম থেকে অনেকটা দুরে নদীর ধারে কাঁঠাল বাগানে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের তাঁরা আদর করে বসাচ্ছেন। তাঁদের বিশ্রামের ব্যবস্থাও করেছেন। ব্যবস্থা করেছেন এইসব অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের খাওয়ানোর। পথের ক্লান্তিতে দুদণ্ড থামছেন সেই সব পরিযায়ী শ্রমিকরা। বিশ্রাম নিচ্ছেন, স্নান সারছেন এবং তারপর সতৃপ্তি আহার গ্রহণ। তারপর আবার শুরু করছেন পথচলা নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে। 
পশ্চিমপাল্লার শ্রমজীবী মানুষজন নিজেদের উদ্যোগে ও সহৃদয় গ্ৰামবাসীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন এই পরিযায়ী শ্রমিকদের আপ্যায়ন সহ খাওয়ানোর ব্যবস্থাপনায়। আজ পঞ্চম দিনে পা দিলো এই ব্যবস্থাপনা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলছে এই খাবার ব্যবস্থা। গড়ে ১৫০জন প্রতিদিন খাচ্ছে। ডিম, মাছ, মাংস, সয়াবিন, ডাল -খাবার মেনুতে থাকছে বিভিন্ন দিনে। 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক তথা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই এই খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্যানিটাইজারও দেওয়া হচ্ছে প্রত্যেককে। স্নানের জন্য রাখা হয়েছে সাবান। কেউ যদি খাবার সাথে নিয়ে যেতে চান, তা হলে তারজন্যও রাখা হয়েছে প্যাকিং-এর ব্যবস্থা। এলাকার শ্রমজীবী মানুষের এই উদ্যোগ সাড়া ফেলেছে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক পরিসরে। 
উদ্যোগী এই দিনমজুর শ্রমজীবী মানুষরা জানিয়েছেন, তাঁরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা। তাঁরাও যখন অন্যত্র কাজে যান সেখানে কি অবস্থায় থাকেন তা তাঁদের জানা। এখন তাঁরা নিজেদের পরিবারের মধ্যে রয়েছেন – কিন্তু এই পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁরা দীর্ঘদিন পরিবার পরিজন ছাড়া হয়ে কাটাচ্ছেন। তাই কোনো কিন্তু নয় – এঁদের সেবা করার এই মহান ধর্মকে তাঁরা হেলায় হারাতে চাননি। 
তাঁরা জানিয়েছেন, উদ্যোক্তা পশ্চিমপাল্লার শ্রমজীবী মানুষ হলেও তাঁরা মাঝপাড়া,পূবপাড়ার মানুষদের কাছ থেকেও পাচ্ছেন অকুণ্ঠ সহযোগিতা। যেদিন যেমন সাহায্য পাচ্ছেন তাই দিয়েই তাঁরা মেনু তৈরী করছেন। আর সেই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁরা এই আতিথেয়তা পেয়ে খুশীতে চোখের জল ফেলছেন। কিন্তু থামলে হবে না, আবার এগোতে হবে বিস্তর পথ। তাই হেমন্তবাবুর গানকে পাথেয় করেই তাঁরা এগিয়ে চলেছেন – পথের ক্লান্তি ভুলে,স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো, কত দূর, আর কত দূর – বলো মা।

আরো পড়ুন