ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আবেদনে ব্যাপক সাড়া পড়লো গোটা রাজ্য জুড়ে। প্রায় সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল জনজীবন। বিশেষজ্ঞদের মতে একবিংশ শতাব্দীর সেরা অঘোষিত ভারত বন্ধ-এ সামিল হলেন রাজ্যবাসী। যদিও জরুরি পরিষেবাগুলো সচল থাকলো অন্যান্য দিনের মতোই। এদিকে জনতার কার্ফুতে ব্যাপক সাড়ার মাঝেই প্রশাসনিক পরিকাঠামোর ফোকর গলে বিনা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যাত্রীরা বর্ধমান স্টেশনে নেমে পৌঁছে গেলেন নিজের নিজের বাড়ি।
এ যেনো প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। গোটা বিশ্ব জুড়ে যখন করোনাকে রুখতে রবিবার জনতার কারফিউ জারী করা হয়েছে সেই সময় বহু ভিন রাজ্যের মানুষ বর্ধমানে এলেন এবং নির্বিবাদে তাঁরা নিজের গন্তব্যস্থলে চলেও গেলেন কোনো স্ক্রিনিং বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই। আর এই ঘটনায় আতংক আরও বেড়েছে। যদিও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গোটা বিষয়টি নিয়েই তাঁরা কড়া নজর রেখেছেন। এরকম কোনো ঘটনার খবর পেলেই তাঁরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলায় এখনও পর্যন্ত বর্ধমান ষ্টেশন, কালনা ও কাটোয়া ষ্টেশন এলাকায় ক্যাম্প করা হয়েছে। ষ্টেশনে যাত্রীরা নামলেই তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরই ছাড়া হচ্ছে। ষ্টেশন থেকে বের হবার জন্য একটিই মাত্র পথ রাখা হয়েছে। রবিবার পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত এই ক্যাম্প চালু ছিল। কিন্তু তারই মাঝে অভিযোগ উঠেছে, রাত্রি ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত বিশেষ করে যে সমস্ত দূরপাল্লার ট্রেন হাওড়ার দিকে যাচ্ছে সেই সমস্ত ট্রেনের যাত্রীরা বর্ধমান ষ্টেশনে নামলেও তাঁদের স্ক্রিনিং-এর কোনো ব্যবস্থা নেই।
জানা গেছে, এভাবেই রবিবার ভোরে সরাইঘাট এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে ৪০জন যাত্রী অরুণাচল প্রদেশ থেকে বর্ধমান ষ্টেশনে নেমে বিনা স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই তাঁরা চলে গেছেন নিজের নিজের বাড়ি। আর এই ঘটনায় সন্দেহ ও আতংক ক্রমশই বাড়ছে। শুধু বর্ধমান ষ্টেশনই নয়, এরই পাশাপাশি এদিন বর্ধমানের নবাবহাট বাসস্ট্যাণ্ড থেকে কোনো বেসরকারী বাস না ছাড়লেও সীমিত সংখ্যায় সরকারী বাস ছেড়েছে। যদিও তাতে যাত্রী ছিল না বললেই চলে। এই বাসস্ট্যাণ্ডেই বহু যাত্রীদল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।
এদের মধ্যেই বালুরঘাটের গঙ্গারামপুর এলাকার বাসিন্দা প্রায় ১২জনের একটি দল গত ১৪ মার্চ গোয়ায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে যান। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরই তাঁদের বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়। এরপর তাঁরা গত ১৯ তারিখ গোয়া থেকে রওনা হন। শনিবার তাঁরা হাওড়ায় নামেন। কিন্তু বালুরঘাট যাবার কোনো গাড়ি না পেয়ে তাঁরা এদিন সকালেই হাওড়া থেকে বর্ধমান ষ্টেশনে আসেন লোকাল ট্রেনে। এখানে নেমেও তাঁদের কোনো পরীক্ষা হয়নি। বর্ধমান ষ্টেশন থেকে তাঁরা চলে আসেন নবাবহাট বাসস্ট্যাণ্ডে। কিন্তু সেখানেও কোনো বাস না পাওয়ায় তাঁরা চরম সমস্যায় পড়েছেন।
সব থেকে সমস্যা দেখা দিয়েছে জনতার কার্ফুর জেরে এদিন বর্ধমান ষ্টেশন সহ কোথাও কোনো খাবারের দোকানই তাঁরা খোলা পাননি। সব মিলিয়ে তাঁরা অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। শুধু এটাই নয়, শনিবার রাতেই গুজরাট, মহারাষ্ট্র থেকে বেশ কিছু মানুষ বর্ধমান ষ্টেশনে নেমেছেন। কিন্তু কোনো বিকল্প গাড়ি না পাওয়ায় তাঁরা এদিন সকাল থেকেই বর্ধমান শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন অবাধেই। উঠেছে প্রশাসনিক নজরদারী নিয়ে প্রশ্নও। অপরদিকে, খোদ বর্ধমান ষ্টেশনে যে স্ক্রিনিং ক্যাম্প করা হয়েছে সেই ক্যাম্পেও করোনা নির্দেশিকাকে তোয়াক্কা না করেই ভিড় উপচে পড়ছে।
যাত্রীদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকার লাইন দীর্ঘতর হয়ে উঠছে। বারবার মাইকে একসঙ্গে না থাকার আবেদন জানানোতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ষ্টেশনের ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, এখানে স্ক্রিনিংএ বেশ কিছু যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা বেশি পাওয়ায় তাঁদের বর্ধমান হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। যদিও এই ধরণের ব্যক্তিদের হাসপাতালে পাঠানো নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সের অভাব প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ৪টি এ্যাম্বুলেন্সকে করোনা জনিত কারণে চালু করা হলেও তাদেরও সবসময় পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অন্য এ্যাম্বুলেন্সও এই ধরণের রোগীদের নিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে সমস্যা চরমে উঠেছে।
এদিন বর্ধমান মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, সারাদিনে প্রায় শতাধিক যাত্রী চিকিৎসার জন্য করোনা ভাইরাসের জন্য তৈরী ওয়ার্ডে এসে পরীক্ষা করিয়েছেন। যদিও সবাইকেই প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে, এদিন জেলাশাসক বিজয় ভারতী জানিয়েছেন, বর্ধমান স্টেশনে ২৪ ঘণ্টাই যাতে ক্যাম্প চালু থাকে সে ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বিশেষ বিশেষ কিছু ট্রেনে যাত্রীদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। সেই সমস্ত ট্রেনের সময়সীমা এবং যাত্রীদের বিষয়ে তাঁদের কাছে তথ্য থাকলেও সরাইঘাট এক্সপ্রেসে যাত্রী আসার বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি এব্যাপারে দ্রুত খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
অন্যদিকে, রবিবার জনতার কার্ফুর জেরে এদিন গোটা জেলা জুড়েই ছিল বনধের চেহারা। রাস্তায় গাড়ি চলেনি। চলেনি বাসও। শুনশান রাস্তাও। ২নং জাতীয় সড়ক দিয়েও গাড়ি চলাচল হয়েছে অতি নগণ্য হারেই। সমস্ত বাজার দোকান ছিল বন্ধ। বর্ধমান হাসপাতালেও এদিন রোগীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। তারই মাঝে খোলা ছিল মদের দোকানগুলি। যেখানে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। এরই পাশাপাশি কয়েকটি মুরগী ও কাঁচা বাজারের দোকান খোলা রেখে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার ঘটনায় পুরসভার অভিযানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ছবিও দেখা গেল এদিন।