ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: অস্বাভাবিক হলেও সত্যি, বাঙালি এই মহামারী পরিস্থিতিতেও স্বাগত জানালো বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ কে। বাস্তবিকভাবে চিরাচরিত প্রথা মেনে না হলেও, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে নববর্ষের শুভেচ্ছে বিনিময়েরও কোন খামতি ছিল না। কিছু মন্দিরে খাতা পুজো হলেও বেশির ভাগ মন্দির কতৃপক্ষই বিজ্ঞপ্তি জারি করে জনসমাগম বাতিল করে দিয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর অন্তত ১লা বৈশাখের দিন রাস্তায় নতুন শাড়ি, নতুন পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে আম বাঙালির ভিড় প্রায় ছিলোনা বললেই চলে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে বর্ধমান শহরের চেহারাটা ছিল একেবারেই উল্টো। চিরাচরিত প্রতিবছরের নবববর্ষের সেই ছবি একেবারে উধাও। মন্দিরে মন্দিরে পুজো দেওয়ার ভিড় নেই। ছিলোনা দোকানে দোকানে খাতা বন্ধ করার মানুষের ভিড়। কয়েকটি মন্দির খোলা থাকলেও সেখানে নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব মেনেই কেউ কেউ পুজোও দিয়েছেন, করিয়ে রেখেছেন হালখাতার পুজোও। যে মিষ্টির দোকানগুলোতে পা ফেলার জায়গা থাকেনা, লাইন পড়ে যায়, সেখানেও প্রায় মাছি তাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আর এসবের থেকেও এবার রীতিমত নজর কাড়ল মাস্ক। নতুন বছরে যখন নতুন পোশাক কেনার ভিড় উপচে পড়ে বাজারে, সেখানে খোদ বর্ধমানের বিসিরোড বরাবর দেখা মিলল মাস্ক বিক্রির লাইন। বিক্রেতারা হরেকরকমের মাস্ক নিয়ে বসে পড়েছেন সামান্য রোজগারের আশায়। নতুন পোশাক নয়, কার্যত নিজের মুখ ঢাকতে মাস্ক কেনার ভিড়ও চোখে পড়েছে – যা রীতিমত অভাবনীয়। ১০ টাকা থেকে ৪০ টাকা। কেউ কেউ একাধিক রংয়ের কিনছেন। মহিলারা আবার পোশাকের সঙ্গে রংয়ের সাযুজ্য রক্ষার জন্য খুঁজে চলেছেন রঙিন মাস্ক। আজ নতুন বছরের নতুন পোশাক পরে নববর্ষকে স্বাগত জানানো নয়, নতুন মাস্ক পরেই মুখ ঢেকে মনে মনে করোনা আপদ কবে বিদায় নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাওয়া যাবে তারই কামনা করেছেন সাধারণ মানুষ।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই রাজ্যের চীফ সেক্রেটারীর নির্দেশ জেলায় জেলায় পৌঁছেও গেছে। সকলকেই মাস্ক, রুমাল বা মুখে দোপাট্টা করে গামছা দিয়ে মুখ ঢাকাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নতুন পোশাক ছেড়ে এখন নতুন বছরে নতুন মাস্ক কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। বর্ধমান বিসিরোডের বাসিন্দা এবং নয়নয় করেও প্রায় ৪০বছর ধরে লেডিস টেলারিং-এর ব্যবসাদার গোপাল মিত্র জানিয়েছেন, তাঁর টেলারিং-এর দোকান এখন বন্ধ। টেলারিং চালু থাকার সময় তাঁর অধীনে প্রায় ১২-১৩ জন কর্মী কাজ করেন। এই সমস্ত কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই মহিলা। কেউ গলসীতে থাকেন, কেউ কলিগ্রাম, কেউ বর্ধমান শহরের নীলপুর, বোরহাট, কেউ আবার মিরেরডাঙা এলাকায়।
স্বাভাবিক সময়ে তাঁরা কাজ নিয়ে যেতেন এবং তাঁর কাছে জামা কাপড় তৈরী করে মজুরী নিয়ে যেতেন। কিন্তু চলতি করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাঁরাও সংকটে পড়েছেন। গোপালবাবু জানিয়েছেন, মাস্কের চাহিদা রয়েছে দেখেই এখন তিনি ৮জনকে নিয়োগ করেছেন। এঁদের মধ্যে ৭জন মহিলা এবং একজন পুরুষ। প্রতিদিন গড়ে এক একজন ৫০-৬০টি করে ১০টাকার মাস্ক তৈরী করে দিচ্ছেন। এজন্য তাঁরা মজুরী পাচ্ছেন ৩টাকা করে প্রতিটি মাস্কের। খরচ বাদ দিয়ে গোপালবাবুর লাভ থাকছে গড়ে ২টাকার কাছাকাছি। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ৪০০-৫০০ পিস মাস্ক (১০ টাকার) বিক্রি হচ্ছে তাঁর। তাঁর কাছে অন্যান্য দামের মাস্ক থাকলেও এই ১০ টাকার মাস্কের চাহিদা তুঙ্গে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি জানিয়েছেন, শুধু বর্ধমান শহরের মানুষই নন, বীরভূম, হুগলি, বাঁকুড়া প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে যাঁরা বর্ধমানে ওষুধের পাইকারী বাজারে আসেন তাঁরাও এখন এই মাস্কের প্রচুর পরিমাণে বরাত দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, প্রথম দিকে এই মাস্ক নিয়ে কালোবাজারি এবং ব্যাপক ধরপাকড় হলেও বর্তমানে বাজারে মাস্কের জোগান বেড়ে যাওয়ায় তা অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। ফলে এখন বিকল্প রুটি রুজির সন্ধানে নববর্ষের দিন নতুন জামাকাপড় বিক্রি নয় মাস্কেই বাজারমাত করছেন তাঁরা।