ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: মঙ্গলবার গভীর রাতে হোস্টেলের তিনতলার নিজের ঘরের ব্যালকনি থেকে রহস্যময় ভাবে নিচে পরে গিয়ে মারা গেলেন বর্ধমান মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের এক হাউস স্টাফ ছাত্র। আর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়ালো বুধবার। মৃত ছাত্রের নাম সেখ মোবারক হোসেন (২৪)। বাড়ি নাদনঘাটের কুসাগড়িয়া গ্রামে। বর্ধমান মেডিকেল কলেজের ৩নং বয়েজ হোষ্টেলের পিছন দিক থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহ উদ্ধারের পরই শুরু হয়েছে বিতর্কও।
বিজ্ঞাপন
খোদ মৃত জুনিয়র ডাক্তারের বাবা সেখ হাফিজুল ইসলাম দাবি করেছেন, তাঁর ছেলের মৃতদেহ দেখে তাঁর স্থির বিশ্বাস, এটা কোনো আত্মহত্যার ঘটনা হতেই পারে না। একেবারেই পরিকল্পিত খুন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের জানানো হয়েছিল মোবারকের খুব বাড়াবাড়ি অবস্থা। কিন্তু তিনি যখন এসে দেখেন তখন তাঁর একমাত্র ছেলে মৃত। তাঁর সন্দেহ, তাকে খুন করা হয়েছে। হাফিজুলবাবু জানিয়েছেন, মৃতদেহে কয়েকটি বাহ্যিক আঘাতের চিহ্নও তাঁরা দেখেছেন।
অন্যদিকে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কল্যাণ সিংহ রায় বলেন, প্রাথমিকভাবে ছাত্রটির উপর থেকে নিচে পরে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। পুলিশী তদন্তও শুরু হয়েছে মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানের জন্য। তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট এবং ফরেনসিক এক্সপার্ট দের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত এখনই পরিস্কার করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এদিন এই ঘটনা সম্পর্কে মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডাঃ শাহ আলম জানিয়েছেন, রাত্রি প্রায় ২.৪৫ মিনিট নাগাদ হঠাৎ জোরে কিছু পড়ার শব্দ শুনে চেঁচামেচি শুরু হয়। তাঁরা বাইরে এসে দেখেন তাদের এক ছাত্র পরে আছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেই অবস্থায় তাঁকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁরা। তাঁর ধারণা কিছু একটা ঘটেছে। সেটা আত্মহত্যা কিনা তাঁরা সঠিক বলতে পারবেন না। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। অন্যদিকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল সুহৃতা পাল জানিয়েছেন, এ ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তাঁরা সবরকমের চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি। তিনি জানিয়েছেন, বয়েজ হোস্টেলের ব্যালকনি যেখান থেকে ছাত্রটি পড়ে গেছে, সেখানে পুলিশ গেছে। ছাত্রদের সাথে কথা বলছে। ডিএসপি ও বর্ধমান থানার আই সি ঘটনাস্থলে এসেছেন। ঘটনার পুরো তদন্ত হবে আইন মেনে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা আসবেন খতিয়ে দেখতে।
এদিকে বুধবার নাদনঘাটের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র মোবারকের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তাঁর একদা শিক্ষক তথা পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলামও। তিনিও জানিয়েছেন, মৃতদেহে যে সমস্ত আঘাতের চিহ্ন ছিল তা তিনতলা থেকে পড়ার জন্য যে ধরণের আঘাত থাকার কথা তা তাঁরা দেখতে পাননি। যদিও ময়নাতদন্তের পরই গোটা বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে তিনিও জানিয়েছেন। জানা গেছে, মৃত ছাত্রের মাথার পিছনে ঘাড়ের দিকে বড়সড় আঘাতের চিহ্ন এবং রক্তক্ষরণের চিহ্ন রয়েছে। তাঁর মুখমণ্ডলের মধ্যে একমাত্র বাম চোখের নিচে কালসিটে দাগ রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করছেন মোবারককে সামনে থেকে চোখের নিচে সজোরে আঘাত করার পর তাঁর মাথার পিছন দিকে আঘাত করা হয়। আর তারপরেই তার মৃত্যু হয়। মৃতের বাবা জানিয়েছেন, মোবারকের পায়ের দিকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাবার চিহ্ন রয়েছে। এর থেকে অনুমান মারা যাবার পর মৃতদেহ ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মোবারকের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালেই সে পাশ করেছিল। বর্তমানে জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে সার্জারী বিভাগে কর্মরতও ছিল। হাফিজুল বাবু জানিয়েছেন, তাঁর ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ভিন্ন সম্প্রদায়ের হলেও বিয়েতে তাঁদের কোনো আপত্তিও ছিল না, তা তাঁরা মোবারককে জানিয়েও দিয়েছিলেন। ফলে এই ঘটনা নিয়ে তাঁর ছেলে আত্মহত্যা করবে এমনটা তাঁরা মানতে পারছেন না।
তাহলে মৃত্যুর কারণ কি? মৃতের পরিবারের সন্দেহ, তাঁদের ছেলের সঙ্গে অন্যান্যদের কোনো হিংসাজনিত শত্রুতাবশেও এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আর তাই তাঁরা খুনের অভিযোগ দায়ের করবেন বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, এদিন হাফিজুলবাবুরা মোবারকের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবর্তে কলকাতার এনআরএসে করাতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল যেহেতু মোবারক বর্ধমান মেডিকেল কলেজেরই ছাত্র, এবং তাঁদের সন্দেহ তাঁকে খুন করা হয়েছে তাই সেক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রভাবিতও হতে পারে। আর তাই তাঁরা আপত্তি জানিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে এদিনই তার ময়না তদন্ত হয়। জানা গেছে, শুধু মোবারক হোসেনই নয়, প্রায় ৩ বছর আগেও একইভাবে সৌরভ দাস নামে এক ছাত্র গুরুতর আহত হন। কোনোরকমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।