খোদ পরিবহন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে এই ওভারলোডিং এর কারণে। কে বা কারা এর পেছনে রয়েছে তা পুলিশ কে দিয়ে তদন্ত করানো হচ্ছে। যদি কোনো সরকারি আধিকারিক বা পুলিশের কোনও কর্তা এর সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, যেসব ব্যক্তিরা এই অসাধু কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে কড়া ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনোভাবেই ওভারলোডিং চলতে দেবেন না, সে যে কেউ হোক না কেন। আর এই ঘোষণার পরই আলোড়ন পড়েছে বালির অবৈধ কারবারিদের মধ্যে।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বেশ কয়েক মাস আগে গোটা রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন নদ ও নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে চালানোর নির্দেশ দেন প্রশাসন ও পুলিশের উচ্চ আধিকারিকদের। স্বাভাবিকভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পরে গোটা রাজ্য জুড়েই শুরু হয়ে যায় অবৈধ বালি কারবারে যুক্ত ব্যক্তিদের ধরপাকড়। পশ্চিম বর্ধমান জেলাতেও শুরু হয়ে যায় ব্যাপক ধরপাকড়। একে একে ধরা পড়ে অবৈধ বালি কারবারের সাথে যুক্ত অসাধু ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন পেশার মানুষজনরা। পশ্চিম বর্ধমনে পুলিশের তৎপরতায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায় অবৈধ বালি কারবার। শুনশান হয়ে যায় বালির ঘাটগুলি। কিন্তু আবার গোটা রাজ্য জুড়ে অবৈধ বালির ওভারলোডিং কারবারে সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট তৈরি করে প্যাড মারফত বালি চালানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
কিছুদিন আগে থেকে পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বীরভূমের বিভিন্ন বালির খাদান ও পাথর খাদান-এর মালিকদের কাছ থেকে অভিযোগ আসছিল যে, একশ্রেণীর ব্যক্তি সিন্ডিকেট তৈরী করে ওভারলোডিং “প্যাড” নিতে বাধ্য করছে তাদের। জানা গেছে, এই ‘প্যাড’ হলো এমন এক চাবিকাঠি যা দেখালে রাস্তায় প্রশাসনের কেউ সেই অবৈধ অতিরিক্ত বালি বোঝাই গাড়িটি আটকাবেন না। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে যাবে সেই গাড়ি তার গন্তব্যস্থলে।
সম্প্রতি বাঁকুড়ার ওন্দা থানা এলাকায় বালি বহনকারী কিছু ট্রাক ও ডাম্পার কে দাঁড় করিয়ে কিছু লোক বাধ্য করছিলো প্যাড নেওয়ার জন্য, স্থানীয় মানুষজন তাদেরকে ঘিরে ধরেন। গাড়িতে করে প্যাড পার্টির মস্তানরা এসেছিল বলে অভিযোগ, ইতিমধ্যেই সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওই আটক ব্যক্তিরা দাবি করেন তারা নাকি নবান্ন থেকে অনুমতি পেয়েছেন অবৈধ বালির ওভারলোডিং কারবারের এই প্যাড চালানোর জন্য। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় বেশ কিছু প্যাডের নমুনা। রীতিমতো রেট চার্ট করে রাখা কিছু কাগজপত্র উদ্ধার হয় তাদের গাড়ি থেকে। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিরা কেউ আসানসোল, কুলটি, দুর্গাপুর ও বড়জোড়া থেকে এসেছিল বলে জানা গেছে। ওই অবৈধ ‘প্যাড’ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে কোনও সংস্থার নাম না থাকলেও আটক ব্যক্তিরা স্বীকারোক্তি দেন যে, এটি প্যাড বলেই চালানো হচ্ছে। আটক ব্যক্তিরা গ্রামবাসীদের এবং বালিঘাট মালিকদেরকে হুমকির সুরে বলেন যে, যদি তাদের কাছ থেকে এই প্যাড না নেওয়া হয় তাহলে পুলিশ দিয়ে তাদের গাড়িগুলিকে কেস দেওয়া হবে। স্থানীয় মানুষজনরা তাদেরকে মারধর করেন।
একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, ওই তোলাবাজ প্যাড বাহিনী বাঁকুড়া জেলার ওন্দা থানা এলাকার স্থানীয় একটি হোটেলে বেশ কয়েকদিন ধরে ভাড়া নিয়ে ছিল। সেখান থেকেই এলাকার ঘাট মালিকদেরকে ফোনে এই অবৈধ প্যাড-এর কথা জানিয়ে তাদের হুমকি দিচ্ছেলেন। একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়া এলাকার এক কম বয়সী যুবক এই জেলার অবৈধ বালির ওভারলোডিং প্যাড চালানোর দায়িত্বে ছিলেন। সূত্র মারফত জানা গেছে, গোয়েন্দা দপ্তর ওই যুবকের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে।
এই ঘটনার পরেই বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হয়। তারপরেই নড়েচড়ে বসে রাজ্য প্রশাসন। সূত্র মারফত জানা গেছে, পুলিশের এক আধিকারিক পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বীরভুম থানা এলাকার বিভিন্ন পুলিশ আধিকারিকদেরকে টেলিফোনে এই অবৈধ প্যাড কারবারীদেরকে সাহায্য করার জন্য অনুপ্রাণিত করছেন। সেই আধিকারিকের সাথে রয়েছেন কলকাতার এক উকিল বাবু বলে জানা গেছে। দুর্গাপুরের এক সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এবিষয়ে রাজ্য সরকারকে লিখিত অভিযোগ জানানোর পর, রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাজ্য পরিবহণ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম কড়া অবস্থান নেন এই অবৈধ প্যাডের কারবার বা ওভারলোডিং বন্ধের বিষয়ে।
সম্প্রতি কসবায় অবস্থিত রাজ্য পরিবহণ ভবনে অবৈধ ওভারলোডিং বিষয়ে একটি আলোচনায় বসেন পরিবহন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সেখানেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, রাজ্য সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে এই ওভারলোডিং এর কারণে। কে বা কারা এর পেছনে রয়েছে তা পুলিশের আইবি কে দিয়ে তদন্ত করানো হবে। যদি কোনো সরকারি আধিকারিক বা পুলিশের কোনও কর্তা এর সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানিয়ে দেন। এদিন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আরো জানান, যেসব ব্যক্তিরা এই অসৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনোভাবেই ওভারলোডিং চলতে দেবেন না সে যে কেউ হোক না কেন।
এদিন মন্ত্রী তার নিজের হোয়াটস্যাপ নম্বর দিয়ে অনুরোধ করেন যাতে রাজ্যে কোথাও যদি অবৈধভাবে ওভারলোডিং চালানোর নামে কোন কারবার চলে তাহলে যেন সাধারণ জনতা থেকে প্রেস মিডিয়া যে কেউ তাকে দ্রুত হোয়াটসঅ্যাপ করে এ বিষয়ে অবগত করেন। তিনি এদিন দাবি করেন যে, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও চাইছেন গোটা রাজ্যজুড়ে যাতে ওভারলোডিং বন্ধ হয় এবং যারা এই ওভারলোডিং অবৈধভাবে কারবারের সাথে যুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়। এদিন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আরো জানান, এবার থেকে রাজ্য পরিবহণ দফতরের পক্ষ থেকে একটি ভিজিলেন্স টিম গঠন করে বিভিন্ন রাস্তায় সারপ্রাইজ চেকিং করবে এবং যেসব গাড়ি গুলি ওভারলোডিং সমেত ধরা পড়বে তাদের পারমিট ক্যানসেল ও তাদের গাড়ি গুলিকে সিজ করার মতো অধিকার দেওয়া থাকবে এই ভিজিলেন্স টিমের কাছে। এদিকে অবৈধ বালির প্যাড কারবারিদের এই খবর কানে যাওয়া মাত্রই মাথায় হাত পড়েছে।
একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকদেরকে হাতে করে তারা যে অবৈধ কারবার চালানোর চেষ্টা করেছিলেন তা সমূলে বিনাশ এর পথে হাঁটছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন কড়া অবস্থান নেওয়ার পরেই ওইসব অবৈধ বালির প্যাড কারবারিরা গ্রেফতারি এড়াতে রীতিমত ছোটাছুটি শুরু করেছে বলে সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে।