ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক, পূর্ব বর্ধমান: সম্প্রতি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে রাজ্য সরকার এবং রাজ্যপালের মধ্যে সংঘাত চরমে উঠেছিল। রাজ্যপালের পদপ্রার্থী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গৌতম চন্দ্রের নাম বাতিল করে রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দপ্তর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আশীষ পানিগ্রহীকে নিয়োগ করে দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয় শিক্ষা মহলে। যদিও এই বিতর্কের জলকে বেশিদূর না গড়াতে দিয়ে খোদ রাজ্যপাল জানিয়ে দিয়েছেন ‘এই চ্যাপ্টার ক্লোজ।’
তবু বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না সদ্য বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য পদে যোগ দেওয়া আশীষ পানিগ্রাহীর। গত কয়েকদিন ধরেই আশীষবাবুকে ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে সোস্যাল মিডিয়া থেকে খোদ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজবাড়ি চত্ত্বর। ইতিমধ্যেই আশীষবাবুর এই নিয়োগ যে যথাযথ হয়নি এবং আগামী দিনে এই ঘটনাকে ঘিরে বিতর্ক আরও বাড়তে চলেছে তারও ইঙ্গিত মিলেছে। খোদ আশীষবাবুর ছেড়ে আসা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রেই জানা গেছে, ২০১৫ সালে আশীষবাবুর বিরুদ্ধে দুটি শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। সেই সময় তিনি ছিলেন প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং নিয়োগ কমিটির দায়িত্বে।
অভিযোগ ছিল, পদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই আশীষ পানিগ্রাহী একজনকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট নিয়ম ভেঙে চাকরীতে নিযুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তা নিয়েও সেইসময় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে সোরগোল পড়ে। আর তারমধ্যে সবথেকে বেশি সোরগোল শুরু হয় আশীষবাবুর নেতৃত্বে তাঁরই এক স্কলার সোমশুভ্র দাশগুপ্ত পাঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের গবেষণা পত্র হুবহু নকল করায়। জানা গেছে, পাঞ্জাবের পাতিয়ালার এই পাঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের গবেষণা পত্র নকল করে তাঁর গবেষণাপত্র হিসাবে জমা দেন সোমশুভ্র দাশগুপ্ত।
বিযষয়টি নজরে আসার পর পাঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৫ সালের এই ঘটনায় শুরু হয় তদন্ত। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এরপর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা পড়ে। আর সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারেই সরাসরি সোমশুভ্র দাশগুপ্তের পিএইচডি ডিগ্রী বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে সোমশুভ্র বাবু যে দুজন বিশেষজ্ঞের অধীনে গবেষণা করেছিলেন সেই আশীষ পাণিগ্রাহী এবং আর কে ত্রিবেদী উভয়কেই দায়ী করা হয়। শাস্তি হিসাবে আশীষবাবুকে একবছরের জন্য তাঁর অধীনে সমস্ত গবেষণা পত্রের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তদন্ত কমিটির কাছে আশীষবাবু এবং আর কে ত্রিবেদী উভয়েই তাঁদের দোষ কবুল করেন বলে জানা গেছে। এদিকে, এহেন গুরুতর অভিযোগে শাস্তি পাওয়া ব্যক্তিকে কিভাবে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসানো হল – এবার তা নিয়েই শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। কেউ কেউ মনে করছেন সম্ভবত রাজ্যপালের কাছে এই বিষয়ে সমস্ত খবর থাকায় তিনি আশীষবাবুর পরিবর্তে গৌতম চন্দ্রকেই সহ উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানোর পর রাজ্যপাল জানিয়ে দেন – এটি ক্লোজড চ্যাপ্টার।
কিন্তু আদপেই কি চ্যাপ্টার ক্লোজড হয়েছে? যেভাবে আশীষ পানিগ্রাহীকে সহ উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে তা আইনীভাবে ত্রুটিপূর্ণ বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। বস্তুত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল এবং রাজ্য উচ্চশিক্ষা দপ্তরের দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করছেন ওয়েবকুটাও। এদিকে নতুন করে এই বিতর্ক শুরু হওয়া সম্পর্কে খোদ আশীষ পানিগ্রাহী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই রিসার্চের ক্ষেত্রে তাঁরা দুজন গাইড ছিলেন। তিনি ছিলেন কো-গাইড। তিনি স্বীকার করেছেন, ওই ছাত্রটি নকল করেছিলেন।
তিনি জানিয়েছেন, রিসার্চের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ পর্যন্ত অন্য গবেষণাপত্র থেকে তথ্য নেওয়া স্বীকৃত। তবে সোমশুভ্রবাবু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত নকল করেছিলেন। আশীষবাবু জানিয়েছেন, তাঁর শাস্তি হিসাবে ১ বছরের জন্য তিনি কোনো গবেষণায় সাহায্য করতে পারেননি। ওই ছাত্রের রিসার্চ পেপারটিও বাতিল হয়। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের নজরদারীতে ত্রুটি ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি তো ওই অন্যায় করেননি। তবুও তিনি ওই নজরদারীতে ত্রুটি করায় তার মাসুলও গুণেছেন। কিন্তু সেই বিষয়টি তো মিটে গেছে। তার পরবর্তীকালে ফের তাঁর অধীনে গবেষণার কাজ হয়েছে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, সহ উপাচার্য্যের পদটি প্রশাসনিক পদ। এর সঙ্গে রিসার্চ কাজের সম্পর্ক নেই। এমনকি ওই ঘটনার সঙ্গে এই পদের কোনো যোগও নেই। বরং এই পদে আসায় তাঁর মাধ্যমে গবেষণার বিষয়টি কমে গেল -এটা বলা যায়।
এদিকে, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে যে দড়ি টানাটানি ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে আশীষ পানিগ্রাহীকে নিয়োগ করার পর নতুন করে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেই বিষয়ে নজরদারী চালাচ্ছে ওয়েবকুটা। এব্যাপারে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি টিচারস্ এ্যাসোসিয়েশন বা বুটার সম্পাদক অরূপ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সহ উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে এখনও পর্যন্ত ওয়েবকুটার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি এটা ঠিকই। কিন্তু তাঁরা নজরে রেখে চলেছেন। যদিও তিনি জানিয়েছেন, সম্প্রতি বুটার পক্ষ থেকে এব্যাপারে একটি বৈঠকে সহ উপাচার্য নিয়োগ যে যথাযথ আইন মেনে হয়নি, এবং তা আইনগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ সে ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর তাই তাঁরা সমদূরত্ব গ্রহণ করেছেন।
যদিও গোটা বিষয়টি এত দ্রুত মিটে যায় তাই তাঁরা কিছু করে উঠতে পারেননি। একইসঙ্গে তাঁরা চলতি করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লকডাউন পর্ব চলায় আপাতত আটকে রয়েছেন। লকডাউন উঠে গেলেই এব্যাপারে তাঁরা নতুন করে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন এবং এব্যাপারে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন। একইসঙ্গে এব্যাপারে ওয়েবকুটায় আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে।
তবে অরূপবাবু জানিয়েছেন, এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে তা গুরুতর অভিযোগ। তাঁরা হতচকিত হয়ে পড়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এটা খুবই চিন্তার বিষয়। একজন সহ উপাচার্যের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকা উচিত নয়। অরূপবাবু আরও জানিয়েছেন, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েও শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়ের অধীনে একজন গবেষক গবেষণাপত্র করার সময় নকল করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শ্রীপতিবাবুর দুটি ইনক্রিমেণ্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ওই ছাত্রের ডক্টরেট ডিগ্রী বাতিল হয়। পরবর্তীকালে শ্রীপতিবাবু রেজিষ্টার হবার পর তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তি তুলে নেবার উদ্যোগ নেন এবং সফলও হন।
অরূপবাবু জানিয়েছেন, এখন তো সফটওয়্যার রয়েছে – নকল করলে তা জানা যায়। তবে এই ধরণের অভিযোগ থাকা উচিত নয়। কারণ ইতিমধ্যেই আশীষবাবু এই পদে আসীন হবার পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েও যদি কোনো ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে এই ধরণের নকল করার অভিযোগ ওঠে তাহলে তিনি শাস্তি দিতে পারবেন তো! অরূপবাবু জানিয়েছেন, এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে অবশ্যই সহ উপাচার্য পদের গরিমা ক্ষুণ্ণ হবে।