রাত পোহালেই কবি প্রণাম, বর্ধমানের রবীন্দ্র ভবনের বেহাল দশা নিয়ে হতাশ সংস্কৃতি মহল

Souris  Dey

Souris Dey

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: রাত পোহালেই ২৫ শে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২ তম জন্মদিন। রাজ্য তথা গোটা জেলা পাশাপাশি জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, বর্ধমান রবীন্দ্র পরিষদ ও বর্ধমান সংস্কৃতি পরিষদের উদ্যোগে বর্ধমানের রবীন্দ্র ভবন চত্বরের আম্রকুঞ্জ, ছাতিমতলায় চারদিন ব্যাপী কবি প্রণামের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এ যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার থাকার পরিস্থিতি। রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের আগে খোদ রবীন্দ্র ভবনের বেহাল অবস্থা নিয়ে ইতিমধ্যেই শহরের সংস্কৃতি মহল বিস্তর আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

রবিবার রবীন্দ্র ভবন ঘুরে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে রীতিমত বেহাল দশা এই ভবনের। রবীন্দ্র ভবনের মূল প্রেক্ষাগৃহের ভিতরের দিকের ছাদ থেকে চাঙ্গর ভেঙে পড়েছে। বসার চেয়ার গুলিরও বেহাল দশা। ধুলোয় ঢেকেছে দর্শকদের বসার চেয়ার। এমনকি দোতলায় ওঠার সিঁড়ি পাশে পড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। কবিগুরুর জন্ম জয়ন্তীর আগে বর্ধমানের রবীন্দ্র ভবনের এই বেহাল দশা দেখে আক্ষেপ করছেন বর্ধমান জেলার সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। ১৯৬৭ সালে সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল রবীন্দ্র ভবন। কয়েক দশক ধরে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঠিকানা বর্ধমান শহরের এই রবীন্দ্র ভবন। কিন্তু সময়ের সাথে আধুনিকতার অভাবে ধীরে ধীরে চাহিদা কমেছে এই ভবনের। মূলত অর্থাভাবের কারণেই প্রয়োজন মতো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি রবীন্দ্র ভবনের বলে অভিযোগ।

বর্ধমান রবীন্দ্র ভবনের সম্পাদক আশিস বিশ্বাস বলেন,”করোনা পরিস্থিতির জন্য দু বছর যাবৎ সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। এই কারণে আয় কমেছে রাবীন্দ্র ভবনের। পরবর্তী কালে রবীন্দ্র ভবনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। আগে দুটি শিফটে ভাড়া দেওয়া হত। প্রতি শিফটে ২৮০০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হত। এখন সেই নিয়ম পরিবর্তন করে ঘন্টা প্রতি ১০০০ টাকা করে ভাড়া ধার্য করা হয়েছে।” বর্ধমানের সংস্কৃতি জগতের চেনা মুখ ও রবীন্দ্র অনুরাগী দেবেশ ঠাকুর বলেন, “রবীন্দ্র ভবনের মতো সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র বাঁচিয়ে রাখতে কেন্দ্র ও রাজ্য সকলের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অন্যান্য জেলার মতো সরকারিভাবে অধিগ্রহণে করে ভবনটি সংস্কার করা হোক। তাতে আগামীদিনে বিভিন্ন সংস্থা গুলি সল্প মূল্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সুযোগ পাবেন।”

প্রসঙ্গত বর্ধমানের সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যবাহী পীঠস্থান রবীন্দ্র ভবনকে বাঁচাতে সরকারী ভাবে অধিগ্রহণের আবেদন গত প্রায় চার বছর আগে থেকেই করা হচ্ছে পরিচালন কমিটির পক্ষ থেকে। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং রবীন্দ্রচর্চার জন্য তৈরী হওয়া এই রবীন্দ্রভবন কে আর পাঁচটা জেলার মতোই রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে চালানোর আবেদনও করা হয় একাধিকবার। উল্লেখ্য, বর্ধমান শহরের বুকে এই রবীন্দ্র ভবনে রয়েছে বহু মূল্যবান বইয়ের লাইব্রেরী, সংগ্রহশালা। দু কাঠা জমির ওপর তৈরী ভবনের পাশাপাশি গত চার বছর আগে সম্পাদক আশীষ বিশ্বাসের উদ্যোগে আয় বাড়াতে তৈরী হয়েছিল একটি আলাদা ভবনও।

রবীন্দ্রভবনের পরিচালন কমিটির সম্পাদক আশীষ বিশ্বাস জানিয়েছেন, রবীন্দ্রভবন পরিচালনার জন্য প্রতিমাসে প্রায় ১ লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। কিন্তু সে অর্থে রবীন্দ্রভবনের আয় নেই। ফলে রক্ষণাবেক্ষণের তীব্র সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। তবুও তাঁরা চেষ্টা করছেন। বর্তমানে কেয়ারটেকার, ঝাড়ুদার, নৈশ প্রহরী সহ মোট ৪জন কর্মী রয়েছেন। কিন্তু নামমাত্র টাকায় তাঁদের মাসিক বেতন দিতে হয় – যা অমানবিকও।
আশীষবাবু জানিয়েছেন, অনেক বছর ধরেই তাঁরা সরকারের কাছে এব্যাপারে আবেদন জানিয়ে আসছেন। সরকারী অনুদানের জন্যও জানিয়েছেন। কিন্তু সে অর্থে তাঁরা কিছু পাননি। ২০১৯সালে কেন্দ্রের টেগোর কালচারাল কমপ্লেক্স নামে একটি প্রকল্পে ১ কোটি ১১ লক্ষ টাকা রাজ্যের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। ওই টাকার মধ্যে কিছু টাকা বর্ধমান রবীন্দ্রভবনের জন্য বরাদ্দ হওয়ায় তা দিয়ে বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থা বর্ধমান রবীন্দ্রভবনের সংস্কারের কাজ শুরু করেছিল। পরবর্তী বরাদ্দ না আসায় সংস্কারের কাজ সম্পূর্ন হয়নি।

আশীষবাবু জানিয়েছেন, বর্ধমান রবীন্দ্রভবনের রুগ্নপ্রায় অবস্থার জন্য রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রীর কাছেও সেই সময় তাঁরা আবেদন জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে বর্ধমানে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক সভা করতে এলে রবীন্দ্র ভবন অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আবেদন পত্র তৎকালীন জেলাশাসক বিজয় ভারতী তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। জেলাশাসক জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্র ভবন পরিচালন কমিটির আবেদন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী এব্যাপারে সেই মুহূর্তে কিছু না জানালেও রবীন্দ্র ভবনের তৎকালীন পরিচালন কমিটি আশান্বিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রভবনকে বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

তৎকালীন জেলা তথা ও সংস্কৃতি আধিকারিক কুশল চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে রাজ্যের ২৩টি জেলার সরকারী ও বেসরকারী রবীন্দ্র ভবনগুলির স্ট্যাটাস জানতে চাওয়া হয়েছিলো। সেই সময় বর্ধমান রবীন্দ্রভবনের অবস্থা জানিয়ে কি প্রয়োজন এবং অধিগ্রহণের প্রস্তাবও পাঠানো হয়। তবে কোনো উত্তর আসেনি। জেলা তথ্য সংস্কৃতি দফতরের বর্তমান আধিকারিক রাম সংকর মণ্ডল বলেন,” রবীন্দ্র পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে প্রস্তাব মিলেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভবনটি সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা বলেন,” এই বিষয়ে প্রস্তাব মিলেছে। ভবনটি সরকারিভাবে অধিগ্রহনের জন্য রাজ্য স্তরে প্রস্তাব পাঠানো হবে।”

আরো পড়ুন