রাত হলেই অন্ধকারে ডুবছে বর্ধমানের সাধের উড়ালপুল, আলোর দায়িত্ব কার তা নিয়েই চাপানতোর

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে উদ্বোধন করেছিলেন বর্ধমানের রেলওয়ে উড়ালপুলের। সেইসময় এই ব্রিজ উদ্বোধন নিয়েও রীতিমতো কেন্দ্র রাজ্য চাপানতোর তৈরি হয়েছিল। যদিও রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে এই অত্যাধুনিক রেল ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করা হয়েছিল। এমনকি এই উড়ালপুল নিয়ে সেইসময় আলোচনার শেষ ছিলোনা। কিন্তু উদ্বোধনের দুবছর পেরোতে না পেরোতেই এই উড়ালপুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। একদিকে রক্ষণাবেক্ষণ, অন্যদিকে তত্ত্বাবধান এই দুই দায়িত্বের মাঝে উড়ালপুলের বাতি স্তম্ভগুলোকে আলোকোজ্জ্বল করে রাখার দায়িত্ব আসলে কার সেই নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।

দুর্গাপুরের দিক থেকে এসে কালনা, কাটোয়া বা কলকাতার দিকে ওঠার রেল ওভারব্রিজের এপ্রোচ রোডের দুদিকের কোনো বাতি স্তম্ভের আলো নেই। আবার আরওবির একদম মাঝে ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্ট থেকে কালনা বা কাটোয়া যাবার দিকে রাস্তার একদিকে আলো জ্বলে তো আরেকদিকের বন্ধ। একই অবস্থা ওভারব্রিজের উপর থেকে কলকাতার দিকে নামার এপ্রোচ রোডের। প্রতিদিনই কয়েকশ পণ্যবাহী ভারী ট্রাক এই রেলওয়ে ওভারব্রিজ দিয়ে রাতে যাতায়াত করে। মাঝেমধ্যেই রাস্তা চিনতে ভুল করায় ওভারব্রিজের উপরেই গাড়ি থামিয়ে সঠিক দিকে যাবার পথ খোঁজার চেষ্টা করেন চালক। এমনকি কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকায় নিজেদের ইচ্ছা মতো আরওবির উপরেই গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় তারা। ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলেই মনে করছেন একাধিক গাড়ির চালক।

এদিকে বর্ধমান শহরের গর্ব নতুন রেলওয়ে ওভারব্রীজের আলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কার? আজও তার কোনো সঠিক উত্তর মিলল না। জেলাশাসক বলছেন এই দায়িত্ব লোকাল বডি অর্থাৎ পৌরসভার। পৌরসভার এক্সিকিউটিভ অফিসার বলছেন, তাঁদের কাছে উড়ালপুলের এখনো কোনো বিদ্যুৎ বিল আসেনি, তাই এব্যাপারে তারা কিছু জানেননা। জেলা পুলিশের ডিএসপি ট্রাফিক অতনু ব্যানার্জি জানান, পৌরসভার সঙ্গে এর আগে উড়ালপুলের আলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটা সত্যি সমস্যার। কারণ উড়ালপুলে সন্ধ্যের পর থেকে আলো না থাকার ফলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

কার যে দায়িত্ব এই আলো জ্বালানোর, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরছে শহরবাসীদের মধ্যে। আর ভাগের মা-এর মতই গত প্রায় মাসাধিককাল জুড়ে অত্যন্ত ব্যস্ততম এই বর্ধমান উড়ালপুল সন্ধ্যে নামলেই ঢেকে যাচ্ছে ঘন অন্ধকারে। ইতিমধ্যেই যার নাম দেওয়া হয়েছে বর্ধমানের অন্ধকার ব্রীজ হিসাবে। কিছুদিন আগেই অন্ধকারের মধ্যে রাস্তার বাঁক নিতে গিয়ে একটি গাড়ি উল্টে কোনোরকমভাবে রেলিং-এর ধারে ঝুলতে থাকে। অল্পের জন্য বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় সেই গাড়িটি। এমনিতেই রাত দশটার পর ট্রাফিক না থাকার ফলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে এই উড়ালপুলে।

উল্লেখ্য এই উড়ালপুলকে প্রায় ১বছর আগে পূর্ত দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। কিন্তু জায়গায় জায়গায় রাস্তায় ছোট বড় গর্ত হয়ে গেলেও ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। অথচ মজার বিষয়, এই উড়ালপুল দিয়েই প্রতিদিন জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলাশাসক সহ জেলা পুলিশ আধিকারিকরা যাতায়াত করেন। এলাকার বাসিন্দারা বিস্মিত সূরেই প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, এঁরা কি গাড়িতে উঠলে সামনে, পাশে কিছু দেখতে পাননা ? এই গর্বের উড়ালপুল নিয়ে কেন প্রশাসনিক উদাসীনতা – প্রশ্ন তুলেছেন এই বাসিন্দারা। এব্যাপারে জেলাশাসক প্রিয়াংকা সিংলার সাফ জবাব, উড়ালপুলের আলোর দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন তথা বর্ধমান পুরসভার। আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব জেলা পুলিশের। তাই এব্যাপারে তাঁরাই যা বলার বলবেন।

কি বলছেন বর্ধমান পুরসভার এক্সিকিউটিভ অফিসার অমিত গুহ? তিনি জানিয়েছেন, উড়ালপুলের আলোর ব্যবস্থা যে তাঁদের এব্যাপারে তাঁরা কিছু জানেন না। কারণ এখনও পর্যন্ত তাঁদের কাছে ওই ব্রীজের আলো বাবদ কোনো বিলই আসেনি। যদিও তিনি জানিয়েছেন, রাজ্য সরকারের একটি নির্দেশনামা আছে – যেখানে যেখানে উড়ালপুল আছে সেখানকার আলোর ব্যবস্থা করবে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু বর্ধমানের ক্ষেত্রে এখনও তাঁদের সঙ্গে এব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে তাঁর মনে পড়ছে না। বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। তিনি আরো জানিয়েছেন, উড়ালপুলের বাতিস্তম্ভগুলোতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে উড়ালপুলের আলো জ্বালানো এবং সৌন্দর্যায়ন যাতে করা যায় সেব্যাপারে আলোচনা করা হবে।

আবার বর্ধমান সদর ডিএসপি ট্রাফিক অতনু ব্যানার্জ্জী জানিয়েছেন, রাত্রি ১০টার পর তাঁদের পক্ষে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিকাঠামো নেই। তথাপি উড়ালপুলে আলোর অভাবে দিক নির্দেশ সংক্রান্ত যে সমস্যা হচ্ছে সে সম্পর্কে পূর্ত দপ্তরকে আরো বেশি করে পথ নির্দেশ বোর্ড লাগানোর জন্য বলা হবে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, উড়ালপুলের আলোর বিষয় নিয়ে তিনি পুরসভার এক্সিকিউটিভ অফিসারের সঙ্গে একপ্রস্থ কথা বলেছেন। আবারও তিনি বলবেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বলাবলি চলতেই থাকুক, কিন্তু সাধারণ মানুষের নিরাপদ যাতায়াতকে সুনিশ্চিত করার দায় কি প্রশাসনের নয়? রাত্রি ১০টার পর কি প্রশাসন ঘুমিয়েই পড়তে থাকবে? কবে ফের উড়ালপুল রাতে উজ্জ্বল আলোয় স্বমহিমায় জ্বলে উঠবে সেই দিকেই তাকিয়ে সাধারণ মানুষ।

Recent Posts