ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,রায়না: মৃত্যুর প্রায় ১৩ বছর পর হঠাৎই স্মরণ সভার আয়োজন কে কেন্দ্র করে জোর রাজনৈতিক শোরগোল পরে গেল বাম আমলের বর্ধমান জেলার এক সময়ের শিরোনামে থাকা রায়নায়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের সেই পুরনো কালো স্মৃতি কি আবার ফিরে আসতে চলেছে পূর্ব বর্ধমান জেলার দক্ষিণ দামোদরের রায়না অঞ্চলে! একদা সিপিএমকে হঠাতে এই বিধানসভা এলাকাই ছিল সংবাদের শিরোনামে। গুলি, বারুদের গন্ধে তখন বাঁধগাছা, বেলসর, কয়রাপুর, জোতসাদি, বনতীর এলাকার মানুষের প্রাণ হয়ে উঠেছিল ওষ্ঠাগত। সকাল থেকে রাত আতংঙ্কই ছিল সঙ্গী।
যদিও ২০১১ সালে নাছোড় গ্রামবাসী তথা তৃণমূলের অদম্য প্রতিরোধের জেরে লাল দূর্গ রায়না থেকে সিপিএমকে উড়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু একাজও সহজ ছিল না। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ধাঁচেই সেই সময় রায়নায় রাস্তা কাটা থেকে গরিলা ধাঁচে সিপিএমের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছিলেন গ্রামবাসী তথা তৃণমূল কর্মীরা। প্রতিদানও দিতে হয়েছিল। ২০০৮ সালে নৃশংস্যভাবে সিপিএমের হাতে খুন হন বাঁধগাছার সাবের আলি। ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় কয়রাপুরের তৃণমূল কর্মী হাসমত আলি মল্লিক, কাজল মোল্লা।
ওই সময়কালেই সমসপুরের গণেশ মালিক খুন হন। শুধু এটাতেই থামেনি সেদিনের সিপিএমের পুলিশ। গোছা গোছা মামলায় জর্জরিত করা হয়েছিল তৃণমূলের নেতাদের। বামদেব মণ্ডল, নিয়ামূল হক সহ রায়না ১নং ব্লকের শতাধিক তাবড় তাবড় নেতা কর্মীদের নামে এখনও কিছু মামলার নিষ্পত্তি বাকি। এই অবস্থায় দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর পর হঠাতই শুক্রবার রায়নার হিজলনা গ্রাম পঞ্চায়েতের জ্যোতসাদি ফুটবল মাঠে রায়নার বিধায়ক তথা পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি শম্পা ধাড়ার নেতৃত্বে সাবের আলি, হাসমত আলি মল্লিক, কাজল মোল্লা এবং গণেশ মালিকের স্মরণসভা করা হল। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল নতুন করে রায়না অঞ্চল জুড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীলড়াই।
এই স্মরণসভায় কার্যত ডাকাই হয়নি তৎকালীন রায়নার আন্দোলনের মুখ তথা বর্তমানে রায়না ১ নং ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি বামদেব মণ্ডলকে। আসেননি বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েতের প্রধানরাও। খোদ বামদেব মণ্ডল বলেছেন, যে পুলিশ গুলি করে তাঁদের কর্মীদের মেরেছে সেই পুলিশ এখন তৃণমূল সরকারের। পুলিশের বিরুদ্ধে বলা কতটা সমীচীন ? শুধু তাইই নয়, সেই সময় যাঁরা পুলিশের সঙ্গে মিশে তাঁদের কর্মীদের ওপর অত্যাচার করেছে এদিন তাঁরাই মঞ্চ আলো করে ছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, লোকে কি বলবে তৃণমূল সম্পর্কে? যদিও তিনি জানিয়েছেন, গোটা বিষয়টি তিনি জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। তাঁকে ডাকা হয়নি তাই তিনি যাননি।
এদিকে এদিনের স্মরণসভায় একদা বামদেব মণ্ডলের অনুচর মহম্মদ ইসমাইল ওরফে শান্ত বর্তমানে নাড়ুগ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রীতিমত হুংকার দিয়েছেন নাম না করেই বামদেব মণ্ডলের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ও সিপিএমের সঙ্গে অশুভ আঁতাত আর দুর্নীতি করে তৃণমূলের ঝাণ্ডা ধরে থাকা এই নেতাকে মেরে নদী (দামোদর) পাড় করে দিতে ৩দিনও সময় লাগবে না তার।’ আর এই বক্তব্যের পরই গোটা রায়না জুড়েই তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কার্যত প্রায় দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে রায়না বিধানসভার তৃণমূলের সংগঠন।
এলাকার তৃণমূল নেতা সেখ মইনুদ্দিন জানিয়েছেন, গুলি খাওয়ার পর কাজল মোল্লা, হাসমত আলি সেখকে তিনিই বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। বামদেব মণ্ডলকে তাঁরা নেতা বলেই মনেই করেন না। স্মরণসভার উদ্যোক্তা শম্পা ধাড়া জানিয়েছেন, এই শহীদের নিয়ে ছোট করে স্মরণসভা হলেও এতদিন বড় করে কোনো স্মরণসভা হয়নি। তিনি বিধায়ক হবার পর এই স্মরণসভা করার প্রয়োজনীয়তা বোঝেন। কারণ যাঁদের রক্তের বিনিময়ে রায়নার মাটি থেকে অত্যাচারী সিপিএম কে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছিল, তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সন্মান জানাতেই এই স্মরণসভার আয়োজন।
এদিন স্মরণসভার পাশাপাশি এলাকার মানুষদের শীতবস্ত্র প্রদান করা হয়। শম্পা ধাড়া জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই আরও বড় করে এক অনুষ্ঠানে এই শীতবস্ত্র প্রদান কর্মসূচির আয়োজন করা হবে। উল্লেখ্য, পুলিশের গুলিতে নিহত হাসমত আলি মল্লিক এবং কাজল মোল্লার শহীদের স্ত্রীকে ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় চাকরিও দিয়েছেন। বস্তুত, শুক্রবার এই স্মরণসভায় যেমন একদিকে তৃণমূলের একাংশ রীতিমত উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন, তেমনই এলাকার বাসিন্দা তথা শহীদ তৃণমূল কর্মীদের এতদিন যারা সঠিক মর্যাদা দেয়নি তাঁদের প্রতি চরম ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন।
এদিন জোৎসাদির ফুটবল প্রাঙ্গণ কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিই জানান দিচ্ছিল তাঁরা বিধায়িকার এই কর্মসূচির সঙ্গেই আছেন। যদিও এতো বছর পর বাম আমলে শহীদদের স্মরণসভার আয়োজন আসলে রায়না বিধানসভায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ করতে চলেছে বলেই জানিয়েছেন একাধিক এলাকাবাসী। তাঁদের আশঙ্কা এই এলাকায় ফের গোষ্ঠী কোঁদল মাথা চাড়া দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেল। ফলে নতুন করে রায়না অঞ্চল জুড়ে অশান্তির বাতাবরণ তৈরী হল বলে এদিন মনে করেছেন তৃণমূলের একাংশ।