রেশনে বিনামল্যে ৫ কেজি চাল মুছে দিচ্ছে ধনী দরিদ্রের বিভাজন, একই পংক্তিতে দাঁড়াচ্ছেন সকলে

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: মাত্র বিনামূল্যে ৫ কেজি চাল একই পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দিল ধনী ও দরিদ্রদের। একই সারিতে সামাজিক দূরত্ব মেনে তকথাকথিত রেশনমুখী না হওয়া মানুষগুলোও এখন ব্যাগ, বস্তা নিয়ে হাজির পাড়ার সেই দরিদ্র মানুষটার পিছনেই। সৌজন্যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। চলতি ১মে থেকে গোটা রাজ্যের পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমান জেলাতেও রেশনে সমস্ত শ্রেণীর রেশন গ্রাহকদেরই মাথাপিছু ৫ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী কয়েকমাস এইভাবেই প্রতি মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি করে চাল বিনামূল্যে দেওয়া শুরু হয়েছে।
ইতিমধ্যেই বিক্ষিপ্তভাবে রেশন ডিলারদের বিরুদ্ধে রেশন দুর্নীতির ঘটনায় সরব হয়েছেন গ্রাহকরা। সেই সরব হওয়া মানুষদের মধ্যেও আজ আর কোনো বিভাজন নেই। ৫ কেজি চালই আজ সমস্বরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। যার ফলশ্রুতিতে শনিবারই বর্ধমান শহরের ৩নং ওয়ার্ডের মেহেদিবাগান এলাকায় রেশন ডিলার রেখা সামন্তকে রেশনে মাল কম দেবার অভিযোগে খাদ্যদপ্তর থেকে শোকজ করা হয়েছে। পাশাপাশি সমস্ত রেশন দোকানেই চলছে কড়া নজরদারী। এতদিন কেবলমাত্র যাঁরা নিয়মিত রেশন নিতেন সেই তথাকথিত দরিদ্র মা্নুষগুলো একচেটিয়া রেশন দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করলেও ততটা গুরুত্ব পায়নি সেই আওয়াজ। এবার পাচ্ছে। সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে – অতএব এটা আমার প্রাপ্য অধিকার। তাই বাদ নেই কেউই।
বর্ধমান শহরের কাঁটাপুকুর এলাকার বাসিন্দা অরুণ প্রসাদ দে- জানিয়েছেন, সাধারণ অবস্থায় রেশন নিতে আসা হয় না। তবে এবার তিনি এসেছেন। বাড়ির ৫জনের মোট ২৫ কেজি চাল তিনি পেয়েছেন। শুধু অরুণবাবুই নয়, জেলার মোট ১৩৫৬টি রেশন দোকানেই একই ঘটনা। রীতিমত রেশন দোকানদাররা হাঁফিয়ে উঠছেন। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার বর্ধমানে প্রশাসনিক বৈঠক করতে এসে খোদ রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও জানিয়ে যান তিনিও আর কে এস ওয়াই – ২এর গ্রাহক। তিনিও এই ৫ কেজি চাল পাবেন এবং তা খাবেনও। তিনি জানিয়েছিলেন, ”আমাদের মত বাবু ভাইরাও এই চাল খাচ্ছেন। ভাল কোয়ালিটির চাল। বর্ধমান জেলার এই সেরা চালই রাজ্যের অন্য জেলা বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া,মেদিনীপুরে যাচ্ছে।”
খোদ জেলা খাদ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলায় মোট অন্ত্যদয় যোজনার নথীভূক্ত রেশন গ্রাহক রয়েছেন ২ লক্ষ ৮৬ হাজার ৯৩৯ জন। এসপিএইচএইচ গ্রাহক রয়েছেন ১৭ লক্ষ ৪১ হাজার ১৯৪ জন এবং পিএইচএইচ গ্রাহক রয়েছেন ১৩ লক্ষ ১৮ হাজার ৮৫৬ জন। এসপিএইচএইচ এবং পিএইচএইচ এই দুটি গ্রাহকের সংখ্যা ৩০ লক্ষ ৬০ হাজার ৫০ জন। এরই পাশাপাশি আরকেএসওয়াই – ১-এর গ্রাহকের সংখ্যা রয়েছে ৯ লক্ষ ৪২ হাজার ৩৪জন এবং আরকেএসওয়াই -২ এর গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে ৮ লক্ষ ৪৯ হাজার ৬৭২জন। এদিকে, এরই সঙ্গে রয়েছেন আরও বেশ কয়েক হাজার গ্রাহক যাঁরা ফুড কুপনের মাধ্যমে সরাসরি রেশনের এই বিনামূল্যে চাল পাচ্ছেন। আবার গোটা জেলায় আরও কয়েক হাজার মানুষ রয়েছেন যাঁরা কার্যতই থেকে গেলেন বঞ্চিত।
কারণ তাঁরা রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করলেও এখনও তাঁদের নাম সরকারী খাদ্য দপ্তরের পোর্টালে নথীভুক্ত হয়নি। তাঁরা এই সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে গেলেন। আর এখানেই অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট বিডিওদের বিরুদ্ধে। খোদ রাজ্যের শাসকদলের নেতারাই বলছেন, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে পরপর দুটি ক্যাম্প করা হয়েছিল। তারপর কেটে গেছে কয়েকমাস। আর বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়োগ করেও এই গ্রাহকদের নাম নথীভুক্ত করতে রীতিমত ঢিলেমি দিয়েছে ব্লক প্রশাসন। কারণ এই কাজে প্রতিটি ব্লকের বিডিওরাই ছিলেন নোডাল অফিসার। তাঁরা যদি চেষ্টা করতেন তাহলে এই একেবারে বঞ্চিত শ্রেণীর সংখ্যাটা আরও কমানো যেত বলে মনে করছেন তাঁরা।
বর্ধমান জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ‌্যক্ষ মেহেবুব মণ্ডল স্বীকার করেছেন এই অসুবিধার কথা। তিনি জানিয়েছেন, গোটা বিষয়টি সম্পর্কে রাজ্য সরকারকে জানানো হয়েছে। যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন কোনো মানুষ যেন অভুক্ত বা অনাহারে না থাকেন তাই কিভাবে এই বঞ্চিত শ্রেণীদের এই সুবিধা দেওয়া যায় তা নিয়ে তাঁরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন, জেলা জুড়ে পুরোপুরি হিসাব না আসলেও প্রাথমিকভাবে তাঁরও ধারণা এই বঞ্চিত শ্রেণীর সংখ্যাটা কয়েক হাজার হবেই। এদিকে, যে সমস্ত মানুষ বিশেষ করে যাঁরা সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বলে পরিচিত এবং যাঁরা রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে মাল নেওয়াকে পছন্দ করতেন না, তাঁরাও এই বিনামূল্যের মরশুমে চাল তুলছেন।
যদিও তা নিয়ে ইতিমধ্যেই অন্য বিতর্ক দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, এই শ্রেণীর মানুষরা রেশন থেকে যে চাল নিচ্ছেন তা নিজে খাচ্ছেন না প্রয়োজন নেই বলেই। সেই চাল তাঁরা অন্য দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন। কেউ নিজের বাড়ির পরিচারিকাকে দিচ্ছেন আবার কেউ পাড়ার গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে আদপেই এই মানুষগুলোর রেশন কার্ড রাখার কি কোনো যৌক্তিকতা আছে ? প্রশ্ন উঠেছে যেখানে সরকার এই শ্রেণীর মা্নুষদের জন্য বিশেষ কার্ডেরও ব্যবস্থা করেছেন – যেখানে রেশনে মাল না নিয়ে কেবলমাত্র রেশন কার্ড রাখা যাবে – তাঁদের কার্ডগুলো কেন সেই সুবিধাভুক্ত হবে না। তাতে সরকারের ওপর বোঝা অনেকটাই কমবে।

Recent Posts