বিজ্ঞাপন
ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া এবং ৭০-র দশকের সুপারহিট হিন্দি সিনেমা দিওয়ার (দেওয়াল) এর চিত্রনাট্য আজও সিনেমাপ্রেমীদের রোমাঞ্চিত করে তোলে। অন্ধকার জগত থেকে দু হাতে অর্থ উপার্জন করে যিনি গরীবের কাছে হয়ে উঠেছিলেন মসীহা, ত্রাতা। ঘটনাচক্রে হুবহু না হলেও সেই দিওয়ার চলচিত্রের একটা জ্বলন্ত বাস্তব দৃষ্টান্ত উপহার দিল সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতি।
একেবারে একটি গরীব মুসলিম পরিবারের জন্ম নেওয়া, পরিবারের ভাল-মন্দের নানান উত্থান-পতনের মাঝে কোনোরকমে ১১ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করেই ইতি টানতে হয়েছিল পূর্ব বর্ধমানের সেই বিখ্যাত (ভিন্নার্থে কুখ্যাত ) জায়গা খাগড়াগড়ের সন্তান সেখ ইসমাইলকে। জীবনে যেমন করেই হোক দুহাতে অর্থ উপার্জন করতে হবে – এটাই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। কিভাবে – সেটা কখনও বিচার্য্যের মধ্যে আসেনি তাঁর।
কয়েক বছর এভাবেই চলছিল। এরপর এক এক করে বর্ধমান শহরের বুকে ৫টি আধুনিক হাল ফ্যাশনের পোশাকের দোকান করেছেন নিজের ব্যবসায়ীক বুদ্ধি এবং কঠিন পরিশ্রম দিয়ে। মোড় ঘোরালেন তাঁরই প্রতিবেশী শিক্ষক সইফুদ্দিন আহমেদ। করোনা তখন চীন ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে থাবা বসাতে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময় মাষ্টারমশাই তার প্রিয় ছাত্রের মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন।
শোনালেন গ্রীক রাজা আলেকজাণ্ডারের সেই বিখ্যাত গল্প। জীবনের শেষ দিনে এসে আলেকজাণ্ডার তাঁর সেনাপতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন ৪জন চিকিৎসক তাঁর কফিন বয়ে নিয়ে যায়। কফিন নিয়ে যাবার সময় রাজপ্রাসাদ থেকে কবরস্থান পর্যন্ত যেন মূল্যবান রত্ন, অলংকার, অর্থ দুহাতে রাস্তায় বিছিয়ে দেওয়া হয় এবং দেহ কফিন বন্দি থাকলেও তার দুহাত যেন কফিনের বাইরে খোলা থাকে। মাষ্টারমশাই আলেকজাণ্ডারের শেষ ইচ্ছার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন ইসমাইলকে। আলেকজাণ্ডার বলেছিলেন, মৃত্যু এসে দাঁড়ালে চিকিৎসকরাও তাঁকে বাঁচাতে পারেনা।
সারাজীবন ধনসম্পদের লোভে তিনি বহু যুদ্ধ করেছেন, মানুষ মেরেছেন কিন্তু তিনি যাবার সময় সেগুলি রাস্তায় ফেলেই যাচ্ছেন। যাচ্ছেন দুহাত খালি রেখে – ঠিক যেমনটি তিনি এসেছিলেন। ব্যস, এই গল্পই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল আজকের রবিনহুড ইসমাইলের। এরই মধ্যে দেশ জুড়ে করোনার জেরে শুরু হল লকডাউন। ইসমাইল শপথ নিলেন তাঁর নিজের এলাকা সেই বিখ্যাত খাগড়াগড় গ্রাম থেকেই অসহায় দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করার। শুরু হলো প্রতিদিন রান্না করে খাবার বিতরণ করা। এক এক করে সঙ্গী হলেন এলাকারই প্রায় ২০টি তরতাজা যুবক।
জাতি, ধর্ম, রাজনীতি – সমস্ত কিছুর ওপরে উঠে শুরু হয়েছিল কাজ। শুধু তাইই নয়, এই মানষিক পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা নিল স্বামীজির বাণী। একদিকে আলেকজাণ্ডা়রের করুণ পরিণতি, অন্যদিকে স্বামীজির বাণী – জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। নির্দ্বিধায় মাষ্টারমশাইয়ের দেখানো পথে ইসমাইল নেমে পড়লেন আর্তের সেবায়। নিঃশব্দে, নিভৃতে।
গত প্রায় ২ মাস ধরে এই খাগড়াগড়ের রবীনহুড বাহিনী গড়ে এক হাজার মানুষকে খাবার দিয়ে চলেছে একটানে। শুধু এটাই নয়, এরই মাঝে নিজের খরচে প্রায় ১৪টি গাড়িতে করে এই খাগড়াগড় ও সন্নিহিত এলাকায় আটকে পড়া প্রায় ৩০০ পরিযায়ী শ্রমিককে তিনি বাড়ি পাঠিয়েছেন। কেউ আসাম, কেউ বিহার, কেউ ঝাড়খণ্ড। সাকুল্যে এখনও পর্যন্ত কয়েক লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গেছে এই কাজে।
ইসমাইলের কথায় – আল্লাহ দুহাত ভরে তাঁকে অর্থ দিয়েছেন। হয়তো কিছু অর্থ ভুল পথেও এসেছে। তবে মাষ্টারমশাই সাইফুদ্দিন আহমেদ তাঁর চোখ খুলে দিয়েছেন। উপার্জিত অর্থ খরচ করে যদি গরীবের আশীর্বাদ পেতে পারেন, তবেই তাঁর জীবন ধন্য হবে। আর তাই পবিত্র ঈদকে মাঝে রেখেই ইসমাইল এই সাদা-কালোর বিভেদের দিওয়ার ভেঙে মানবপ্রেমের এক অনন্য নজীর সৃষ্টি করে ফেলেছেন। একলহমায় মুছে দিয়েছে অভিশপ্ত খাগড়াগড়ের স্মৃতি – তাঁর কর্মকান্ড বুঝিয়ে দিয়েছে খাগড়াগড়ে মানুষ মারার জন্য বোমা বানানো হয়না – মানুষকে বাঁচানোর জন্য ইসমাইলের মত হাজারো বোমা তৈরী – মনুষত্ববোধের জাগরণ ঘটাতে।