সৌরীশ দে,রায়না: পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলের চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে উঠে এল পূর্ব বর্ধমানের রায়নায়। সেই গ্রাম দখল কে কেন্দ্র করে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর ( ব্লক সভাপতি ও বিধায়কের) লড়াইয়ে বুধবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রায়না ১ব্লকের নতু অঞ্চলের শুকুর গ্রামে কার্যত তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৮রাউন্ড গুলি চালানোর অভিযোগ ঘিরে উত্তাল রায়নার রাজনৈতিক মহল। এলাকার দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সদস্য মৃগাংক সিং( লালন) কে প্রথমে রাস্তায় ফেলে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার পর রাতে তাকে লক্ষ্য করে চলল গুলি। গুলি লেগেছে তার পায়ে। এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন লালনের বাবা বাদল সিংও। তার পায়ে দুটি গুলি লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পারা গেছে। পালিয়ে কোনরকমে প্রাণে বেঁচে গেছেন দেবরাজ পাত্র নামে আরেক তৃণমূলের কর্মী। গুরুতর জখম অবস্থায় দুজনকেই পুলিশ উদ্ধার করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাতেই ভর্তি করে।
ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে রায়না ১ পঞ্চায়েত সমিতির মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ দপ্তরের কর্মাধক্ষ্য পার্থ বসু বলেন,’ গতকাল দুপুর আড়াইটা নাগাদ শুকুর গ্রামের স্থানীয় তৃণমূল নেতা মৃগাঙ্ক সিং ওরফে লালন ব্যক্তিগত কাজে পাশের রমানন্দপুর গ্রামে যাচ্ছিলেন। সেই সময় রাস্তায় একটি শ্মশাণ এর কাছে তিনজন কে মদ খেতে দেখেন। এরপর তিনি সেখান থেকে চলে যান। পাশের গ্রামে কাজ সেরে ফেরার পথে ওই তিনজন মদ্যপ অবস্থায় লালনের পথ আটকায়। লালন কে লাথি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেয় তারা। লালন মোটর সাইকেল তুলতে গেলে লাঠি, বাঁশ, ইঁট দিয়ে বেধড়ক মারধর করে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে গ্রামের লোক ছুটে আসলে ওই দুষ্কৃতীরা লালন কে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন লালন কে উদ্ধার করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে লালনের চিকিৎসা করানো হয়।’
এই ঘটনার পর রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ লালন সিং দেবরাজ পাত্রের সঙ্গে যখন শুকুর বাজারে ওষুধ কিনতে আসেন, সেই সময় সৌমেন রায় ওরফে রন্টু তাদের লক্ষ্য করে পরপর বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় বলে অভিযোগ। প্রায় ৭ থেকে আট রাউন্ড গুলি চালানো হয় বলে অভিযোগ। পার্থ বসু বলেন,’ দেবরাজ পাত্র কোনরকমে একটি লাইট পোস্টের পিছনে নিজেকে আড়াল করলেও একটি গুলি লালনের পায়ে এসে লাগে। এই সময় লালনের বাবা বাদল সিং ঘটনাস্থলে ছুটে আসলে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। তার পায়েও দুটি গুলি লেগেছে। গুলি চালানোর পর মোটর সাইকেল নিয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে যায় সৌমেন রায়।
জানতে পারা গেছে, যার বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠছে সেই সৌমেন রায় ওরফে রন্টু রায়নার বিধায়ক তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি শম্পা ধাড়ার অনুগামী বলে পরিচিত। এমনকি যে দুষ্কৃতীরা মৃগাঙ্ক সিং ওরফে লালন কে মদ্যপ অবস্থায় মারধর করেছে তারাও এই সৌমেন রায়ের লোক বলেই স্থানীয়দের একাংশ জানিয়েছেন। অভিযোগ, ২০২১ সালে এই সৌমেন রায় কে বিজেপির স্থানীয় নেতা হিসেবে মানুষ চিনত। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পর রায়নার প্রচুর বিজেপি কর্মী, নেতা দলবদল করে তৃণমূলের যোগদান করে। আর সেই সময় এই সৌমেন রায় তৃণমূলে যোগ দেয়। যদিও এই নতু অঞ্চল থেকে বিধানসভা ভোটে প্রায় ১৪০০ ভোটে লিড ছিল তৃণমূলের। আর এর পিছনে লালনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাভাবিকভাবেই ২০১৩ সাল থেকে পঞ্চায়েত সদস্য তথা এলাকার দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা লালন কে গুলি চালানোর ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
রায়না ১ব্লকের তৃণমূল সভাপতি বামদেব মন্ডল এই ঘটনায় দলের কেউ যুক্ত নয় বলেই জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে এলাকায় অশান্তি সৃষ্টি করার একটা চেষ্টা করছে এলাকার কিছু সিপিএম, বিজেপির লোকজন। এতে লাভ কিছু হবে না। রায়না ১ব্লকে বিরোধীদের কোন জায়গা নেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে শুধু হিজলনা অঞ্চল থেকেই আমরা ১১২৫৪ভোটে লিড পেয়েছি। সেদিন যারা বিরোধী দলে থেকে চোখ রাঙিয়ে ছিল, আজ তাদের অনেকে জামা পাল্টে ভাবছে তৃণমূলের এসে সুবিধা ভোগ করবে। আমরা এইসব বরদাস্ত করবো না। রায়নার মাটি থেকে সিপিএম কে উৎখাত করেছি, এই মাটি তৃণমূলের ঘাঁটি। এখানে দাঁত ফোঁটাতে এলে দাঁত ভেঙে যাবে।’
অন্যদিকে রায়নার বিধায়িকা তথা পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি শম্পা ধাড়া এই ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘ এটি নিছকই একটি পাড়াগত বা এলকাগত সমস্যা। এর সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। সম্ভবত মদ খাওয়া কে কেন্দ্র করে দুপক্ষের বচসা থেকেই এই গন্ডগোল। ইতিমধ্যে অভিযোগ জমা পড়েছে, পুলিশ প্রশাসন গোটা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। ‘ যদিও গুলি চালানোর ঘটনায় যার নাম উঠে আসছে সেই সৌমেন রায় ওরফে রন্টু র প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে শম্পা ধাড়া জানিয়েছেন, রায়নায় বিরোধী বলে কেউ নেই, এখানে সবাই তৃণমূল। নেতা নেত্রীদের অনুগামী ও কাছের লোক অনেকেই থাকতে পারে। তবে গুলি চালানোর বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। পুলিশ গোটা ঘটনার তদন্ত করছে।’
এদিকে স্থানীয় সূত্রে জানতে পারা গেছে, দুপুরে লালন কে মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার পর পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেলেও রাতে নিজেদের লোকজন নিয়ে লালন সিং ও বাদল সিং পাল্টা সৌমেন রায় কে আক্রমণ করতে যায়। আর সেই সময়ই সৌমেন রায় তার সঙ্গে থাকা রিভলভার থেকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় আত্মরক্ষার্থে। এই সময় লালন সিং ও বাদল সিংয়ের কোমরের নিচে পায়ে গুলি গিয়ে লাগে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাতে শুকুর বাজার এলাকায় গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযুক্তের খোঁজে তল্লাশি চলছে। গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।