বর্ধমান পুরসভা এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স বাবদ বকেয়া প্রায় কোটি টাকা! উদাসীন কর্তৃপক্ষ

Souris  Dey

Souris Dey

সৌরিশ দে,বর্ধমান: দীর্ঘদিন ধরে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করে আসলেও বছরের পর বছর কয়েক হাজার ব্যবসায়ী এই লাইসেন্স রিনিউ না করানোয় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বর্ধমান পুরসভা। থমকে যাচ্ছে শহরের বহু উন্নয়নমূলক কাজ। পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স দপ্তর সুত্রে জানা গেছে, বর্ধমান শহরে কম বেশি প্রায় ৪০হাজারের কাছাকাছি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেই বাম পুর বোর্ড থেকে বর্তমান তৃণমূল পরিচালিত পুর বোর্ডের আমলেও পুরসভায় নথিভুক্ত ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীর সংখ্যা মাত্র ১০ হাজারের কাছাকাছি। যার মধ্যে পুরনো লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীর সংখ্যাই প্রায় ৮ হাজার। বাকি বিপুল পরিমাণ এই ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স করানোর জন্য কোন সদর্থক ভূমিকা কার্যত কোন বোর্ডই নেয়নি বলেই পুরসভারই কর্মীদের একাংশ অভিযোগ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

যার ফলে একদিকে পুরসভার নিজস্ব তহবিলের আয় যেমন বাড়েনি, অন্যদিকে প্রতিবছর লাইসেন্স রিনিউ করানোর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে কমতে থাকায় বকেয়ার পরিমান বেড়ে কোটি টাকার অংক ছাড়িয়েছে। এরই মধ্যে রাজ্য সরকার ই-ডিস্ট্রিক্ট পোর্টালের মাধ্যমে রাজ্যের সমস্ত পুরসভা কে সংযুক্ত করে দেওয়ায় সরাসরি এখন আর কাউকেই পুরসভায় এসে ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ বা নতুন অনুমোদন নিতে হয়না। অনলাইনের মাধ্যমেই টাকা জমা করা এবং নতুন ট্রেড এনালিস্টমেন্ট সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করার সুবিধা তৈরি হয়েছে। আর এই কারণে পুরসভার দায়িত্ব অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে বলেই জানা গেছে। ফলে বর্ধমানে কে কোথায়, কতদিন ধরে, কি ধরনের ব্যবসা, কবে থেকে শুরু করেছে তার সঠিক তথ্যই পুরসভার কাছে আর থাকছে না।

আর এই পরিস্থিতির মূল কারণ হিসেবে খোদ পুর কর্তৃপক্ষের একাংশ যে তথ্য সামনে নিয়ে এসেছেন তাতে পুরসভারই উদাসীনতা, গাফিলতি আর নজরদারির অভাবকেই দায়ী করা হয়েছে। এমনকি কয়েকবছর আগে ই-ডিস্ট্রিক্ট পোর্টাল চালু হওয়ায় পুরসভা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর থেকে নজরদারি একপ্রকার প্রায় সরিয়েই নিয়েছে বলে অভিযোগ। ফলে কার্যত বছরের পর বছর ধরে পুনর্নবীকরণ ছাড়াই শহরে শতাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সরকারি লক্ষ লক্ষ টাকা কর ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও ভ্রুক্ষেপ নেই পুরসভার।

প্রসঙ্গত ইদানিং নতুন ব্যবসা করতে শুরু করা অনেকেই যতটা পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন ( নিজেদের প্রয়োজনেই), তুলনায় পুরনো ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ তাদের লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করা থেকে কার্যত বিরত থাকছে। মারাত্মক যে তথ্য উঠে এসেছে তা  হল, দীর্ঘদিন ধরে ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ না করার ফলে বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া হয়ে গেলেও সেই ব্যবসায়ীরাই গোপনে ই-ডিস্ট্রিক্ট পোর্টালে ফের নতুন করে দরখাস্ত জমা দিয়ে লাইসেন্স বের করে নিচ্ছে। ফলে আগের বকেয়া টাকা আর পুরসভা পাচ্ছে না। বলা যেতে পারে, এই অনলাইন ব্যবস্থার কারণে রীতিমত আঁটঘাট বেঁধেই নিজেদের এককালীন জরিমানার অর্থ বাঁচাতে পুরনো লাইসেন্স অনেকেই আর পুনর্নবীকরণ করছে না। ফলে ট্রেড লাইসেন্স খাতে পুরসভার নিজস্ব তহবিলের আয় কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।

যদিও এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সরকারের উচিত ট্রেড লাইসেন্স সম্মন্ধিও নিয়মের আরো সরলীকরণ করা বলেই অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ এই পোর্টালের যাবতীয় পরিচালনা রাজ্য থেকেই হয়ে থাকে। পুরসভা কেবলমাত্র আপলোড হওয়ার পর তথ্য জানতে পারে মাত্র। বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান পরেশ চন্দ্র সরকার বলেন,’ আমরা সারা বছর নিয়মিত ক্যাম্প করে ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করার জন্য আবেদন জানাই। বিভিন্ন বাজার এলাকা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ন রাস্তার মোড়ে মাইকিং করে ব্যবসায়ীদের এই বিষয়ে সচেতন করা হয়। কিন্তু তারপরেও নতুন ব্যবসা করতে আসা ব্যক্তিরা যতটা ট্রেড লাইসেন্সের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, পুরনো ব্যবসায়ীরা তা করছেন না।

বরং অনেকেই পোর্টালে নতুন ভাবে অ্যাপ্লাই করে ফের ট্রেড লাইসেন্স বের করে নিচ্ছে। আমরা জানতেও পারছি না। তবে এরফলে ব্যবসার ধরন এক থাকলেও পাল্টে যাচ্ছে তাদের পিন নম্বর। স্বাভাবিকভাবেই কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য নিজেদের অজান্তেই নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। সমস্যায় পড়ে পুরসভার দ্বারস্থ হওয়ার পরই এই বিষয়গুলি সামনে আসছে। খুব শীঘ্রই শহরের পুরনো ব্যবসায়ী যাদের ট্রেড লাইসেন্স বাবদ বকেয়া রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে পুরসভা। পাশাপাশি যেকোন ধরনের ব্যবসা পুর এলাকায় করলে ব্যবসায়ীকে পুরসভার ট্রেড এনলিষ্টমেন্ট সার্টিফিকেট নিয়েই ব্যবসা করতে হবে – এব্যাপারে সচেতন করতেও  প্রচার অভিযানে নামা হবে।’

বর্ধমান পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স বিভাগের দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল সুমিত শর্মা বলেন,’ আমরা এব্যপারে শহরের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক সময়ে প্রচার অভিযান চালিয়েছি, সেক্ষেত্রে নতুন ট্রেড এনালিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট নেওয়ার যে প্রবণতা দেখা গেছে সেই তুলনায় পুরনো লাইসেন্স রিনিউ করানোর সংখ্যা খুবই কম। আসন্ন বোর্ড মিটিংয়ে ট্রেড লাইসেন্স বাবদ বকেয়া আদায় নিয়ে আলোচনা করা হবে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, কয়েকবছর  আগেও যেখানে ৮ থেকে ৯হাজার বর্ধমান শহরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স প্রতিবছর রিনিউ করতেন, চলতি আর্থিক বছরে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৫৮০ টিতে। তুলনায় নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ই-ডিস্ট্রিক্ট পোর্টাল অনুযায়ী চলতি বছরে নথিভুক্ত হয়েছে ৪২৫৮ টি। যেটা বিগত কয়েকবছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী অনেকটাই বেশি।

পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, নতুন ট্রেড এনালিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট নেওয়ার সংখ্যা বেশী হওয়ার কারণ এই সার্টিফিকেট ছাড়া ব্যাঙ্কে যেমন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না, তেমনই বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলেও ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। কিন্তু পুরনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো নেই। ফলে বছরের পর বছর পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ না করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে শহরের ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ। সব মিলিয়ে প্রতিবছর পুরসভার রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ পৌঁছে যাচ্ছে কোটি টাকার উপর। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে পুরসভা কেই।

আরো পড়ুন