ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,জামালপুর: সযত্নে তৈরি করা বিদ্যালয়ের কিচেন গার্ডেনের কলমী শাক দিয়ে জয়যাত্রা শুরু হলো। ভাত, মুগডাল, এঁচোরের তরকারীর সাথে বিদ্যালয়ের নিজস্ব বাগানের থেকে সংগৃহীত কলমী শাক ভাজা দিয়েই দুপুরের আহার করল ছাত্র ছাত্রীরা। ছাত্র-ছাত্রীসহ বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত সকলেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের এই উদ্যোগের ভুয়সী প্রশংসা করছেন।
বিদ্যালয়ের পতিত এক ফালি জমি। যেদিকে নজর দিলেই চোখে পড়বে জঙ্গল, কাঁচ ভাঙা, রাবিশের স্তুপ। বিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে যত মেরামতির কাজ হয়েছে, ততই রাবিশের পাহাড়ের উচ্চতা দীর্ঘতর হয়েছে। গুটিকয়েক মান্ধাতা আমলের পুরাতন দরজা, ভাঙা টয়লেট, যা সাপের নিরাপদ আশ্রয়স্থল (বহুবার তেনাদের সার্থক দর্শন লাভ করেছেন অনেকেই)। এককথায় বিদ্যালয়ের যেকোন আবর্জনা ফেলার সহজ জায়গা ছিল এটি। চার বছর আগে বিদ্যালয়ের এই দুরাবস্থার মধ্যেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার নিয়ে আসেন সোমনাথ সিনহা।
প্রধান শিক্ষক সোমনাথ সিনহা বলেন, ‘এতদিন ধরে বিদ্যালয়ের প্রায় ভেঙে পড়া শ্রেনীকক্ষ গুলি মেরামত, রং করা, পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত করা, নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থাদি গ্রহনের পর মনে হলো ঐ পতিত জমিটি কিভাবে কাজে লাগানো যায়। হঠাৎ করে মনে হলো যদি এগুলো সব পরিষ্কার করে কিছু গাছ লাগানো যায় তো খুব পরিবেশ বান্ধব হবে। প্রায় একমাস ধরে বিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের জমে থাকা আবর্জনা (আনুমানিক কমপক্ষে ১০/১২ ট্রলি) সাফ করলো আমাদের প্রিয় গনেশ। চাষাবাদের উপযোগী ভালো আউস মাটি ফেলা হলো। দেওয়া হলো গোবর সার। এবার কি গাছ লাগানো যায়? একটি ভালো ‘কিচেন গার্ডেন’ তৈরী করলে কেমন হয়?
মাথায় ভাবনা আসার সাথে সাথে বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির সভাপতি শ্যামলেন্দ্রনাথ মিত্র কে অবগত করলে, তিনিই পরবর্তী সকল ব্যবস্থাদি গ্রহনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। স্বহৃদয় লক্ষনদা চাষের দায়িত্ব নিলেন। মাস দুয়েক আগে বিভিন্ন সবজির বীজ বপন করে শুভ সূচনা হলো কুলীনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের কিচেন গার্ডেনের। লাগানো হল ঢেঁড়স, ডেঙো ডাঁটা, লাউ, কুমড়ো, ছাঁচি/চাল কুমড়ো, পুঁইশাক, কলমি শাক ও পেঁপে গাছ।
কবে গাছ বড় হবে, কবে বাগানের উৎপাদিত ফসল আমাদের ছোট ছোট শিশুদের মিড-ডে-মিলে খাওয়ানো হবে তারই প্রতীক্ষায় ছিলাম আমরা সবাই। গত বুধবার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে শুভক্ষণের শুরু হল। বাগানের সবজি তুলেই এদিন মিড ডে মিলের রান্নার পদ তৈরি হল। এতদিন যে ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদের এই বাগান কে সযত্নে লালিতপালিত করছিল, আজ সেই বাগানেরই ফসলের তৈরি তরকারি খেয়ে দারুন খুশি তারা। খুশি অভিভাবকরাও। ইতমধ্যেই কিছু সবজি পরিণত হতে শুরু করেছে। বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ঢেঁড়স আর ডেঙো ডাঁটা পাওয়া যাবে। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে লাউ, কুমড়ো, ছাঁচি/চাল কুমড়ো ফলবে। পুঁইশাক ১৫ দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে। ফলে বিদ্যালয়ের সবজি বাগানের ফসলই এখন মিড ডে মিলের রসদ জোগাতে শুরু করেছে।
সোমনাথ বাবু বলেন, ‘ ২০১৯ এর জুলাই মাস। কুলিনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে এসে এক মিশ্র অনুভূতি হয়েছিল। বিরাট মাঠ আর নির্মল গ্রাম্য পরিবেশ যদি ধনাত্মক দিক হয়, তাহলে ভেঙে পড়া স্কুল বাড়ি, ধ্বংস স্তুপ বাথরুম, টিউবওয়েল এর আয়রন এর সৌরভ মিশ্রিত পানীয় জল আর ধুঁকতে থাকা শিক্ষা ব্যবস্থা ঋনাত্মক দিকের পাল্লা ভারী করে রেখেছিল। কলকাতার নামী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে আসা অনেকটা এভারেস্ট বেসক্যাম্পে ট্রেকের পর অযোধ্যা পাহাড় ঘুরতে যাওয়ার মত লাগছিল। তবে সময় মানুষ কে অনেক শিক্ষা দেয়। সাথে থাকতে থাকতে গড়ে ওঠে ভালোবাসা। মনে জেদ আসে কাজ করে পরিবর্তন আনার এক শপথ নেয় মন। সাথে পাই অগ্রজপ্রতিম বিদ্যালয়ের সভাপতি মহাশয় কে। যুদ্ধে নেমেই পরি। ফল? নিজের মুখে বললে তো বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে। তবুও বলি সেদিনের কুলীনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় আর আজকের কুলীনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক পার্থক্য – ভিতরে এবং বাইরেও।
প্রসঙ্গত বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে কিন্তু কখনও কোন বিভাগেই মাথা তুলে দাঁড়ায় নি। ব্লকের মধ্যেও পিছনের সারির তকমা কোন এক অজানা কারনে সেঁটে গিয়েছিল। আজ কিন্তু বিদ্যালয়ের চেহারা আর আগের মতো নেই।বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য বিশুদ্ধ ও শীতল পানীয় জলের ফিল্টার বসেছে। প্রতিটি টয়লেটে জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছাত্র/ছাত্রী এবং বিদ্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্যালয়ের প্রতি কক্ষে সি.সি. ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বিদ্যালয়ের ভগ্নদশা অংশগুলি সারিয়ে রঙ করা হয়েছে। প্রতি শ্রেণীকক্ষে কিছু পরিমাণ বেঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে। একটি অস্থায়ী ডাইনিং হলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিচেন গার্ডেন তৈরি করা হয়েছে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা স্কলারশিপ পরীক্ষা দিচ্ছে এবং সাফল্য অর্জন করছে।খেলাধুলা তে বহু বিভাগে জেলায় চ্যাম্পিয়ন ও হয়েছে। মক ইয়ুথ পার্লামেন্ট প্রতিযোগিতায় সমগ্র ব্লকের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে এই বিদ্যালয়। ভগ্নস্তুপ ও জঞ্জাল সরিয়ে সেখানে শিক্ষক/শিক্ষিকাদের গাড়ি রাখার স্ট্যান্ড করা হয়েছে।
তবু এখনও যে বিষয়গুলোর অভাব রয়েছে সেগুলোও উল্লেখ করার দরকার। যেমন, মেয়েদের টয়লেটটি ভগ্নপ্রায়। ছাত্র -ছাত্রীদের সাইকেল স্ট্যান্ড নেই। স্টেজ নেই। মিড ডে মিলের জন্য স্থায়ী রান্নাঘর ও ডাইনিং হলের প্রয়োজন।লাইব্রেরী নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘরের অভাবে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা যাচ্ছে না। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে ফিজিক্যাল সায়েন্স ও ইংরেজির দুটি পোস্ট ফাঁকা। স্মার্ট শ্রেনীকক্ষ নেই।পাঁচিলগুলিও ভগ্নপ্রায় এবং দক্ষিণ দিকে কোন পাঁচিল নেই। ব্লক স্তর থেকে জেলা স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন মহলে দরবার করেও উক্ত বিষয়ে কোন প্রতিকার হয়নি এবং সুরাহা মেলেনি। সকলের কাছেই শুধু আশ্বাস মিলেছে কিছু অগ্রগতি হয়নি।
উপরের বর্ণিত পরিকাঠামোর অভাব পূরণ হলে বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীদের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে। আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হলে সমগ্র এলাকায় লেখাপড়ার আমূল পরিবর্তন ঘটবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে ছাত্র -ছাত্রীদের সংখ্যা ২৬৯ জন, স্থায়ী শিক্ষক শিক্ষিকা ১০ জন। প্যারা টিচার ২ জন, ICT ১ জন। ইংরেজি ও ফিজিক্যাল সায়েন্স পদে দীর্ঘদিন শিক্ষক নেই। এসব সত্ত্বেও আমরা আশাবাদী ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপে, সহৃদয় ব্যক্তিবর্গের বাড়ানো সাহায্যের হাত ধরে আর সহযোদ্ধাদের কঠোর পরিশ্রমে একদিন জয় আসবে এবং কুলীনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় সর্বক্ষেত্রে মহীরুহে পরিনত হবে।