দামোদর নাট্যোৎসব – ফেলে আসা দিনের সার্থক মঞ্চায়ন

Souris  Dey

Souris Dey

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়,বর্ধমান:  বর্ধমান কুশীলবের উদ্যোগে গত ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি সংস্কৃতি লোকমঞ্চে অনুষ্ঠিত হল দামোদর নাট্যোৎসব। প্রথম দিন উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অংশুমান ভৌমিক। তিনি দক্ষিণবঙ্গের বুকে নাটকের প্রসারে বর্ধমান কুশীলবের সদর্থক ভূমিকার কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

প্রথম দিনের নিবেদনে ছিল অন্য থিয়েটারের প্রযোজনা প্রথম রাজনৈতিক হত্যা। দুটি পৃথক যুগের সময়ের ঘূর্ণনে আবর্তন করতে থাকে এ নাটক। এ যুগের যুবক বাবর চৌধুরী অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হলে ঘড়ির কাঁট‍া ঘুরতে থাকে উল্টোদিকে। অগ্নিযুগের বিপ্লবী কানাইলাল, বারীন ঘোষ, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকিদের সেই গৌরবোজ্জ্বল আত্মবলিদান দর্শকদের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে দেয় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। নাট্যকার দেবাশিস রায় নিজেই এ নাটকের মঞ্চ আলো আবহ ও নির্দেশনায় ছিলেন। অভিনেতাদের অনবদ্য শারীরিক রিফ্লেক্স, অদ্ভুত ধরনের বিভিন্ন সিকোয়েন্স থেকে মঞ্চে আগমন বরাবরই নাটকে একধরনের সাসপেন্স তৈরি করছিল। দেশাত্মবোধক গানগুলি এই নাটকের অমূল্য সম্পদ। নরেন গোঁসাইকে বিশ্বাসঘাতকতার দণ্ড দান বুঝিয়ে দেয় বাংলার মাটিতে প্রতিবাদ কখনও স্তিমিত হয় না। নাটকের শেষে এ যুগের বাবর যেন সেযুগের কানাইলালের মধ্যে নিজেকে ফিরে পায়।

দ্বিতীয় দিনে ছিল ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের নাটক প্রতিধ্বনি প্রযোজনা ফেলে আসা মেগাহার্টজ। সুর ও ইথারতরঙ্গের ফেলে আসা দিন উঠে আসে এ নাটকে। শেষ দিনের মুখ্য আকর্ষণ ছিল উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাটক এক মঞ্চ এক জীবন। মহানট গিরিশচন্দ্র ঘোষের জীবনের এক খণ্ডিত অংশকে এ নাটকে তুলে আনেন নির্দেশক সৌমিত্র মিত্র। পূর্ব পশ্চিম প্রযোজনার এ নাটকে গিরিশচন্দ্রের ভূমিকায় ছিলেন বর্তমান সময়ের খ্যাতকীর্তি অভিনেতা দেবশংকর হালদার। সহজাত নৈপুণ্যে তিনি গিরিশচন্দ্রের চরিত্রের আলো ও আঁধার দুটি দিকই সমান্তরালভাবে তুলে ধরেছেন। মহানট নিজের ব্যক্তিগত জীবনে নানা বিপর্যয়ের মাঝেও বঙ্গ রঙ্গশালাকে জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া যেন মাধুরী দান করেছিলেন। তা সবই দেখানো হয়েছে এ নাটকে।

ইতিহাসের পাতা থেকে এ নাটকে উঠে এসেছেন রসরাজ অমৃতলাল, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, প্রতাপচাঁদ জহুরি, গুর্মুখ রায় র‍া। অবশ্যই এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। যিনি বলেছিলেন থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়। মদ্যপ বিপথগামী কিন্তু অমেয় প্রতিভার অধিকারী গিরিশচন্দ্রের প্রতি ঠাকুরের ছিল অপার করুণা। ঠাকুরের ভুমিকাটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আইচ বাবু। গিরিশচন্দ্র ঘোষ অপূর্ণ থাকেন তাঁর প্রিয় শিষ্যা নটি বিনোদিনীকে ছাড়া। বিনোদিনীর জন্ম বেশ্যাগৃহে । কিন্তু অপার শক্তিময়ী এই অভিনেত্রীকে নবজন্ম দেন গিরিশচন্দ্র। গুরু শিষ্যার সম্পর্কটি ছিল বহুমাত্রিক। বিনোদিনী নিছক মহানটের স্নেহের পাত্রই ছিলেন না। ছিলেন তার অনেক বেশি কিছু।

এই চরিত্রে অসাধারণ দক্ষতা দেখান ঝুলন ভট্টাচার্য। গুর্মুখ রায়ের লালসার কাছে একদা বিনোদিনীকে বলি দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র অর্ধেন্দুশেখররা। তৈরি হয়েছিল বাঙালির গর্বের স্টার থিয়েটার। ইতিহাসের সেই আলোছায়াভরা অধ্যায় উঠে আসে এই নাটকে। গিরিশচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী সুরতসুন্দরীর ভূমিকায় কোয়েল রায় ও তিনকড়ি দাসীর ভূমিকায় সিলভিয়ার অভিনয় খুব ভাল লাগল। এবারের উৎসবে পরিতোষ রায় স্মৃতি স্মারক সম্মান পেলেন বিভাস চক্রবর্তী। তবে তিনি শারীরিক কারণে বর্ধমান আসতে পারেননি। সোমালি মিত্র স্মৃতি স্মারক সম্মান প‍ান ঝুলন ভট্টাচার্য। বর্ধমান কুশীলবের পক্ষে দর্শকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা প্রিয়তোষ রায়।

আরো পড়ুন