ফোকাস বেঙ্গল প্রতিবেদন: পৌষের শীতে বাঙালি গৃহস্থের বাড়িতে পিঠেপুলির আয়োজন হয়না এমন বাড়ির সংখ্যা খুব নগণ্য। আর এই পিঠেপুলি বানানোর জন্য মূল উপকরণ চালের গুঁড়ো লাগবেই। কিন্তু এই চাল গুঁড়ো ভাঙার সেই ঢেঁকিই আজ একপ্রকার বিলুপ্ত। পরিবর্তে জায়গা দখল করেছে মেশিনে ভাঙা চালের গুঁড়ি।আগেকার যুগে গ্রামের প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে ধান ভাঙা ও চালের গুড়া কিংবা চিড়া কোটার জন্য ঢেঁকির ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল। ঢেঁকিছাটা চালের কদরও ছিল খুব। এই চালের ভাতের মজাই ছিল আলাদা। ঢেঁকিছাটা চালে পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, তাই ঢেঁকিছাটা চালের চাহিদা আজও কমেনি। কিন্তু এই চালের চাহিদা থাকলেও সেই ঢেঁকি আজ প্রায় বিরল।
ধান ভাঙা ঢেঁকি আমাদের গ্রাম বাংলার প্রাচীন গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশেও এর একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। একসময় গ্রামগঞ্জসহ সর্বত্র ধান ভাঙ্গা, চাল তৈরি, গুড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙ্গানোসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো চিরপরিচিত ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। তখন এটা গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। কুটির শিল্প তথা পেশা হিসেবেও ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গা হত। গ্রামের গৃহস্থের গৃহবধূরাই সাধারণত ঢেঁকি চালাতেন।
জনশ্রুতি আছে, সত্তরের দশকে সর্বপ্রথম দেশে রাইসমিল বা মেশিন দিয়ে ধান থেকে চাল বের করার প্রচলন শুরু হয়। তখন থেকেই ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। একসময় সারাদেশে বছর জুড়ে তের পার্বণ পালিত হত। গ্রামগঞ্জে একটার পর একটা উৎসবের আমেজে ভরপুর থাকত। বাংলায় হেমন্ত উৎসব, পৌষ পার্বণ, বসস্ত উৎসব, বর্ষবরণ, বিয়ে উৎসব, পিঠা তৈরির উৎসব, হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা পূজা, গাঁয়ের মেলাসহ নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন হত। এখনও এইসব উৎসব হয়, তবে ঠিক আগের মত সেই প্রাণ আর নেই। নেই সেই আবেগও।
গ্রামীণ নারীরা চালের গুঁড়ি দিয়ে নানা রকম পিঠা যেমন সাদা পিঠা, ভাজা পিঠা, চিতল পিঠা, রুটি পিঠা, ঝুরি পিঠা, চুঙ্গা পিঠা, তালের পিঠা, পাটি সাপটা পিঠা, নুনগরা, নুনরডোবা, পব, সমুছা সহ তৈরি করতেন হরেক রকমের পিঠাপুলি। এসব তৈরি হত ঢেঁকিছাটা চালের গুঁড়ি দিয়ে। কালের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় এইসব পিঠা তৈরিতে আজকাল ঢেঁকিছাটা চালের গুঁড়ি তেমন আর ব্যবহার হয়না। একদা গ্রামের বড় গৃহস্থ বাড়িতে ঢেঁকি থাকাটা ছিল অনেকটাই বনেদীয়ানার পরিচয়। সমৃদ্ধ গৃহস্থ পরিবারের পরিচয় বহন করত এই ঢেঁকি। আর আজ ঢেঁকি হারিয়ে গিয়ে কার্যত এর ব্যবহারও বিলুপ্ত। তাই গ্রাম বাংলার গৃহস্থ বাড়িতে এখন আর শোনা যায়না ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাংলার প্রচলিত প্রবাদ ‘ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে ‘ তারও বাস্তবতা ফুরিয়েছে।