বিনোদন

ঐতিহাসিক শহর বর্ধমানের কালী পুজোর ইতিহাস

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর বর্ধমানে আজও পূজিত হয়ে আসছে শতাধিক বছরের পুরনো একাধিক কালী প্রতিমা। বেশ কয়েকটি কালী কে নিয়ে রয়েছে ইতিহাসও। কালী পুজোর দিন সেই সমস্ত কালী পুজোর ইতিহাস জনসমক্ষে আরো একবার উপস্থাপন করলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সর্বজিত যশ।

সোনার কালী : নারায়ণ কুমারী ১৩০৬ বঙ্গাব্দে স্বপ্নাদেশ পেয়ে সোনার কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। সোনার কালীবাড়ির বিগ্রহ দশ মহাবিদ্যার ভুবনেশ্বরী কালী । অর্থাৎ এই কালীমূর্তি প্রসন্নমূর্তি। এখানে শিব নেই। রানি নারায়ণ কুমারী একজন ব্রাহ্মণ কুমারীকে বেদীর নীচে প্রতিষ্ঠা করে অষ্টধাতুর এই ভুবনেশ্বরী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ভুবনেশ্বরী কালীর ডানদিকে দক্ষিণাকালী, বাঁদিকে মঙ্গলচণ্ডী। ঈশান কোণে পঞ্চমুণ্ডির আসন আছে। লোককথা হল, মা ভুবনেশ্বরীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার সময় এখানে একটি শিশুকন্যাকে জীবন্ত অবস্থায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। এখনও কালী পুজো উপলক্ষে এই মন্দিরে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। মূল মন্দিরের দক্ষিণ দিকে দুটি নারায়ণীশ্বর শিবমন্দির ও বেলগাছ আছে। দেবীর সিংহাসনটি রুপোর। বেদিটি শ্বেতপাথরের। সোনার কালীবাড়ির প্রধান পুরোহিত শিবপ্রসাদ ঘোষাল বলেন, মন্দিরের সারা বছরের যাবতীয় খরচ ডঃ প্রণয়চাদ মহতাব বর্ধমান দেবসেবা অফিস মারফত দেন।

 

 

কঙ্কালেশ্বরী কালী : কাঞ্চননগরের কঙ্কালেশ্বরী মূর্তি প্রত্নতত্ত্ববিদ ও মূর্তিতত্ত্ববিদদের কাছে এক বিস্ময়। এ পর্যন্ত মূর্তিটি নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। কেউ বলেন বৌদ্ধ দেবী, কেউ বলেন জৈন, আবার কেউ মনে করেন বাংলার নিজস্ব সম্পদ – শাক্ত সম্প্রদায়ের উপাসিতা দেবীর উগ্রমূর্তি। মূর্তির বর্ণনা করে বলা যায় – কালো পাথরের মূর্তি, একদা এর উপর কালো রং মাখানো হয়েছিল, পায়ের দিকে সেই কালো রং উঠে গেছে ও ভিতরের কালো পাথর দেখা যায়। মূর্তিটি প্রায় সাড়ে তিন হাত লম্বা, চওড়ায় প্রায় দেড় হাত। মূর্তিটি মন্দিরের দেওয়ালে সাঁটা আছে। দেবী কঙ্কালেশ্বরীর আকৃতি কঙ্কালের আকারের।

দুর্লভা কালী : নবাব হাটের খুব কাছে অবস্থিত দুর্লভা কালী মন্দির। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এই দেবী। অনেকে চলতি কথায় “দুল বালা” কালী বলে থাকেন। মায়ের যে মূর্তিটি সামনে দেখা যায় তার পিছনে আসল মূর্তি আছে। আসল মূর্তিটি পাথরের। একটি ছোট পিতলের সিংহাসনে মায়ের মাথার পিছনে স্থিত আছে। প্রত্যহ পূজার সময় মূর্তি নামিয়ে পূজা করা হয়। এই মূর্তিটি হল একখণ্ড কালো পাথরের উপর মায়ের চোখ, মুখ ও কান অল্প খোদাই করা। কাছ থেকে তা বোঝা যায়। বাকী অংশ অমসৃণ পাথরের খণ্ড ছাড়া কিছু নয়, সর্বসাধারণকে যে মূর্তিটি দেখতে দেওয়া হয় তা ঢালাইয়ের মূর্তি, তাতে পিতল-রং করা। একই স্থানে শিবমন্দির, নারায়ণ মন্দির, তুলসি মঞ্চ প্রভৃতি রয়েছে। দুর্লভা কালী খুব জাগ্রতা দেবী বলে প্রচার। এখানে মায়ের পূজা ছাড়াও প্রতিদিন তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা হয়। প্রতিদিন ভোগ হয় যা ‘শিব ভোগ” নামে পরিচিত, এই ভোগ একটি বাঁধানো বেদীতে রাখা হয়, যা শিয়ালেরা খেয়ে যায়। বৈশাখ মাসের সংক্রান্তির দিন খুব ধুমধাম সহকারে পূজা হয়। পূর্বে প্রতি অমাবস্যায় ও পূর্ণিমায় ছাগ বলি হত, এখন শুধুমাত্র দুর্গা পূজার অষ্টমী ও নবমীতে ছাগ বলি হয়।

ফৌজদারী কালী: শহরের প্রাণকেন্দ্র খোসবাগানে এখনও প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে ফৌজদারি কালীর পুজো হয়। তিনি বাগদি সম্প্রদায়ের কালী বলেই পরিচিত। আজও এই কালীকে ঘিরে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। ১৩৪৫ খ্রিঃ পূর্বে ফৌজদারী কালীমা বাগদী পাড়ার কালী রূপে পূজিতা হতেন। সেই সময় খোসবাগানের যে কয়েক ঘর অদিবাসী ছিলেন তাঁরা সকলেই স্বেচ্ছায় এই পুজো শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় প্রতিমা নিরঞ্জন কে কেন্দ্র করে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ মসজিদের সামনে দিয়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া নিয়ে আপত্তি তোলে। বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় একাধিক প্রতিমার নিরঞ্জন। শহরের ভেরি খানা এলাকায় মাসাধিককাল এই সব প্রতিমা পড়ে থাকে।

এই অপমানের প্রতিবাদ করতে বর্ধমানের বিশিষ্ট আইনজীবী গিরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গৃহে একটি গোপন বৈঠক হয়। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলাই মুখোপাধ্যায়, শ্রীকুমার মিত্র, রাজকৃষ্ণ দত্ত, তারাপদ পাল, প্রাণদা মুখোপাধ্যায়, প্রণবেশ্বর সরকার প্রমুখ তৎকালীন বর্ধমানের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ঐ বৈঠকে স্থির হয় এরা যেকোন একটি প্রতিমা নিয়ে আইন অমান্য করে নিরঞ্জন সমাপন করবেন। তখনকার দিনে বারোয়ারী পুজা বা সার্ব্বজনীন পুজার চল ছিল না। সমস্ত প্রতিমাই বাড়ীর প্রতিমা হিসাবেই পুজিত হতো। সেহেতু বাড়ীর প্রতিমা নিয়ে আইন অমান্য করলে বাড়ীর মালিকের উপর সমস্ত দায় বর্তাবে এই চিন্তায় ঐ প্রচেষ্টায় সাড়া দিতে কেউ সাহস পায় নি। কিন্তু ঐ প্রস্তাব যখন খোসবাগান সরস্বতীতলার প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে আসে তখন যতীন্দ্র নাথ বিষ্ণু মহাশয়ের মাধ্যমে ঐ বাগদি পাড়ার কুল গাছ তলার কালী প্রতিমা পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়।

সেই মোতাবেক ১৩৪৫ সনের ৩০শে কার্তিক রাত্রি ৮ ঘটিকায় স্থানীয় যুবকেরা একটি ঢোল ও একটি কাসি নিয়ে তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় নামক একটি যুবকের মাথায় প্রতিমা কে চাপিয়ে শহর পরিক্রমায় বের হয়। তখন বর্ধমান থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ছিলেন মহম্মদ বাবর আলি। তিনি ঐ শোভাযাত্রাকে বাধা না দিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শোভাযাত্রা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করার পর ঐ সমস্ত যুবকদের গ্রেপ্তার করেন এবং তাদের এই কর্মের জন্য কালীর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা রুজু করেন। বর্ধমান আদালতে আইন অমান্য ও অন্যান্য মিথ্যা অপরাধে তাদের ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়। তখনকার ব্যারিষ্টার মহল বিনা পারিশ্রমিকে মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করে সকলকে মুক্ত করে আনেন এবং তখন থেকে শোভাযাত্রা করার আইন সম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই থেকেই এই দেবী ‘ফৌজদারি’ কালী নামে খ্যাত। বর্তমানে ফৌজদারী কালী মায়ের পুজো ও শোভাযাত্রা বেশ ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়।

বীরহাটার বড়মা কালী: লোকমুখে একথা শোনা যায় যে যখন জি.টি. রোডের পীচ রাস্তা হচ্ছিল। সেই সময়েও এই দেবী বিরাজমান ছিলেন। আরও শোনা যায় যে বাঁকা নদীর তীরবর্তী এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলে জঙ্গলে পূর্ণ, এই স্থানে একটি বেদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় যখন ঐ অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছিল। জনমজুরেরা মাটি কাটতে কাটতে ওই বেদী দেখতে পান। সম্বল শুধু এইটুকুই, এর থেকে বেশী এই মন্দিরের প্রাচীন ইতিহাস জানা যায় না।

এ কথাও জনশ্রুতি যে একসময় বর্ধমান বর্গী হামলার শরিক থেকেছে। ক্রমে ক্রমে জনগণ এই বর্গীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। এই অঞ্চল থেকেই জনগণ বর্গী হটাও অভিযান চালায়। আর আজকের এই বীরহাটা শব্দটি বর্গী হটাও শব্দেরই পরিবর্তিত রূপ। আবার অনেকের মতে অনেক বীরাচারী সন্ন্যাসী পুরাকালে এখানে আসতেন। বীরহাটা এই নামকরণ হয়েছে সেখান থেকেই।

বর্ধমানের প্রাচীন লোকজনের কাছ থেকে একথা শোনা যায় যে তখনকার দিনে রক্ষাকালী পুজো করা হত ম্যালেরিয়া, মহামারির আবির্ভাব ঘটলে এর থেকে মুক্তিলাভের জন্য। একথা অনুমান করা যায় যে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাঁশ খড় তালপাতার ছাউনি ঘেরা দিয়ে, শক্তপোক্ত ভাবে বেদীটিকে পুনর্ণিমান করা হয়। এই জায়গার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়। এই সময় দেবীর পূজার কাজে নিযুক্ত ছিলেন দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের কোন এক ঘোষাল পরিবার।

বংশগোপাল নন্দ মহাশয়ের অর্থানুকুল্যে এবং স্বর্গীয় উপেন্দ্রনাথ রায় মহাশয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কালক্রমে এই বাঁশ খড় আর তালপাতার ছাউনি পাকা ঘরে পরিবর্তিত হয়। তখন থেকেই প্রতি অমাবস্যায় মা’র পূজা শুরু হয়। নাসিকের কাছে গোদাবরী তীরে ত্রম্বকেশ্বরে মন্দিরের চূড়ার আদলে এই মন্দিরের চূড়া এবং মন্দির অলঙ্কৃত করা হয়। বীরহাটার বড়মা কালীর প্রতিষ্ঠার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এ সম্পর্কে যে জনশ্রুতি আছে তা হল বিরাট এক কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজা। ডাকাতে কালী নামে এই কালী দেবীকে অনেকে অভিহিত করে থাকেন।

তবে এই কালী বর্ধমান শহরে বড়মা নামেই পরিচিত। এই মূর্তিটি বর্ধমান শহরের সর্ববৃহৎ কালী মূর্তি। হয়তো এই কারণেই এই নামে মা’কে ডাকা হয়। বর্তমান বীরহাটা কালীমাতা ট্রাষ্ট কমিটি পূজা ও মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুমোদিত বিশ্বেশ্বরী চতুষ্পাঠীর অধ্যক্ষ শ্রী দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়, কাব্য ব্যাকরণ, কৃত্য স্মৃতিতীর্থ, বৌদ্ধ দর্শনাচার্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১৯৯২খ্রী থেকে এই কালী মূর্তির শুদ্ধাচারে পূজা করে আসছেন।উনিই এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। প্রতি অমাবস্যায় মায়ের বিশেষ পূজা, হোম ও ভোগ হয়।

ভৈরবেশ্বরী : বর্ধমানের মঙ্গলাপাড়ায় আনুমানিক তিনশ বছর আগে এই দেবীর প্রতিষ্ঠা হয়। ভৈরবেশ্বরী কালী নিমকাঠের তৈরি। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে গৌরাঙ্গের মূর্তি নির্মাণের মাধ্যমে এদেশে নিমকাঠের মূর্তি তৈরি শুরু হয়। সেই সময়ই এই ভৈরবেশ্বরী মূর্তি প্রতিষ্ঠা পায় বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বর্ধমান রাজ পরিবারের এক পূৰ্ব্ব পুরুষ ভৈরবচাঁদ কাপুর নিম কাঠের কালী মূর্ত্তি তৈরী করে ঐ দালান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন প্রায় তিনশ বছর আগে। ভৈরব চাঁদ কাপুর ছিলেন নিঃসন্তান। মা কালীর প্রতি যেমন তাঁর অগাধ ভক্তি ছিল, তেমনই তিনি মা কালীর আরাধনাও করতেন।

লোককথা অনুযায়ী তাঁর সন্তান না হওয়ার জন্য সন্তান কামনায় প্রতিদিন মায়ের কাছে প্রার্থনা জানাতেন। তাঁর কাতর প্রার্থনায় মা কালী একদিন রাতে ভৈরবচাঁদ কাপুরকে স্বপ্ন দেন অর্থাৎ ভৈরবচাঁদ কাপুর স্বপ্নাদিষ্ট হন যে মা কালী যেন তাঁকে বলছেন “তোর সন্তানের জন্য দুঃখ কিসের। আমিই তোর সন্তান হয়ে, তোর মেয়ে হয়ে তোর কাছে থাকব কথা দিচ্ছি”। এরপরই মাঘ মাসের রটন্তী চতুদ্দশীর দিন নিমকাঠের কালী মূর্ত্তি তৈরী করে মন্দির নির্মাণ করে মাকে প্রতিষ্ঠা করেন ভৈরবচাঁদ কাপুর। সেই থেকেই মায়ের পুজোর শুরু। মায়ের নিত্য পুজো হয়। মাঘ মাসের রটন্তী চতুদ্দশীর দিন প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে মায়ের মহা সমারোহে পূজা হয় এবং বাৎসরিক শ্যামাপূজার দিন খুব জাঁকজমক করে মায়ের পুজো হয়।

ক্ষেত্র সমীক্ষাকালে দেখাগেছে মায়ের মন্দির দক্ষিণমুখী, মন্দিরে নিম কাঠের তৈরী প্রাচীন কালী মূৰ্ত্তি তো আছেই, এছাড়াও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ, গৌর নিতাই মূর্ত্তি, নারায়ণ শিলা এবং আরো, অনেক বিগ্রহের নিত্য পুজো এই মন্দিরে হয়। বাৎসরিক কালী পূজায় এবং প্রতিষ্ঠা দিবসে অর্থাৎ মাঘ মাসের রটন্তী চতুর্দশীতে ছাগ বলি হয়। এ ছাড়াও মানসিকের পুজোয় ছাগ বলি হয়।  প্রতিমার প্রাচীনত্ব নিয়ে বহু তথ্য শোনা যায়। শোনা যায় এই ধরনের নিম কাঠের কালী মূর্ত্তি নাকি একমাত্র পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরেই আছে। অনেকের মতে এই কালী মূর্তি ভারতবর্ষের মধ্যে দ্বিতীয় নিম কাঠের কালী মূৰ্ত্তি।

 

বহ্নিবলয় সৎকার সমিতির পুজো : স্বাধীনতার পূর্বে চালু হয়েছিল শ্যামবাজার অপর্ণাঘাটের (আসলে হবে অর্পনাঘাট) বহ্নিবলয় সমিতির পুজো। সমিতির মতানুযায়ী প্রায় ৬৫-৭০ বছরের পুরনো এই পুজো। কালীপুজোর রাতে ছাগ, আখ সহ অন্যান্য ফলের বলি হয়। পুজোয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পুজো উপলক্ষে আশেপাশের বাসিন্দাদের ভোগপ্রসাদ বিতরণ করা হয়।

ত্রিকোণা পুকুর কালী : বর্ধমানের জি. টি. রোডের উপর অবস্থিত ত্রিকোণা পুকুর কালী মন্দির। প্রায় ১১০ বছরের পুরাতন দেবী। উদয় সংঘের তত্ত্বাবধানে এই পুজো মহা ধুমধাম সহকারে হয়। বারো মাসই মায়ের মূর্তি থাকে। বাৎসরিক কালীপুজো ছাড়াও প্রত্যেক অমাবস্যায় মায়ের পুজো ও ভোগ বিতরণ হয়। মায়ের প্রতিদিন দু’বেলা পুজো হয়। ত্রিকোণা কালী মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় সাড় তিন ফুটের মত।

ছিন্নমস্তা কালী : জি. টি. রোডের ধারে পুলিশ লাইনের কাছে ছিন্নমস্তা মায়ের মন্দির অবস্থিত। আগে জি. টি. রোডের ধারে পুজো হত। এখন বাঁধানো মন্দির আছে, সেই মন্দিরেই মায়ের পুজো হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় মায়ের পুজো খুব ধুমধাম সহকারে হয়। মায়ের মন্দিরটা ভাদ্র মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে ভাদ্র মাসেও পুজো হয়।

অফিসার্স কলোনী কালী : জি. টি. রোডের ধারে অফিসার্স কলোনি কালী মন্দিরটি অবস্থিত। প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ বছরের পুরোনো এই কালী। স্বৰ্গীয়া গোলাপ সুন্দরী দাসীর নামে মন্দির সংলগ্ন জায়গাটি ছিল। এই বংশেরই কেউ এই কালী প্রতিষ্ঠা করেন বলেন শোনা যায়। মন্দিরে সারা বছরই পুজো হয়। তবে, বাৎসরিক কালীপুজোর রাতে খুব ধুমধাম করে পুজো হয়।

কমলাকান্ত কালী: ১২১৬ বঙ্গাব্দে শক্তি সাধক কমলাকান্তকে চান্না গ্রাম থেকে বর্ধমানে নিয়ে এসে মহারাজ তেজ চাঁদ তাকে সভাপণ্ডিত করেন। তখন থেকেই সাধক বর্ধমানে তাঁর সাধনার ক্ষেত্র খুঁজে পান। মহারাজ তেজচাঁদ কোটালহাটে বারো কাঠা জমির উপর মায়ের মন্দির এবং সাধকের থাকার বাসস্থান করে দেন। সাধক কমলাকান্ত পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে দিনের পর দিন সাধনা করতে লাগলেন। পিছনে বেলগাছের তলায় চলতে থাকে কাল ভৈরবের পূজা। কারণ শক্তিকে জাগ্রত করতে হলে শিবকেই চাই। একটি নিমগাছের তলায় তিনি চণ্ডাল, শৃগাল ও বানরের মুখ দিয়ে পেতেছিলেন ত্রিমুণ্ডীর আসন। এবং শেষ পর্যন্ত সাধনার দ্বারা তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। কমলাকান্ত মারা গেলেও স্থানটি হিন্দু তীর্থ হয়ে ওঠে।

কমলাকান্ত কালী মায়ের মূর্তিটি প্রায় ১২-১৪ হাত লম্বা, মাটির মূর্তি। বারো মাস মায়ের মূর্তি থাকে। কিন্তু আশ্বিন মাসের দ্বাদশী অথবা ত্রয়োদশীতে এই মূর্তি নিরঞ্জন হয়। পুনরায় নতুন মূর্তি তৈরী হয়। নিত্য পূজা হয় বেশ শুদ্ধাচারে। নিত্য মায়ের ভোগ হয়। ঠিক মধ্যাহ্নে মায়ের অন্নভোগ হয়। সন্ধ্যায় মায়ের লুচি-মিষ্টি ভোগ হয়। ত্রিসন্ধ্যায় মায়ের আরতি হয় এবং পূজা হয়। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় বারের পূজা হয়। বহু ভক্ত সমাগম হয়। প্রতি অমাবস্যায় মায়ের হোম হয়।

আগে ছাগ বলি হতো – এখনও শ্যামা পূজায় এবং মানত থাকলে ছাগ বলি হয়। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে ভক্তরা পুজোর ডালি সাজিয়ে মায়ের পুজো নিয়ে আসেন। নববর্ষ, বিজয়া দশমী, মঙ্গলচণ্ডী পূজা, বিপদত্তারিণী পূজার দিনগুলিতে এখানে অনুষ্ঠান চলে। শ্যামাপূজার সময় বেশ আড়ম্বরে পূজা হয়। কার্তিক মাসের ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন কমলাকান্ত মন্দিরে প্রতি বৎসর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (বর্ধমান শাখা), বর্ধমান সংস্কৃতি পরিষদ ও কমলাকান্ত কালী সমিতি সমবেতভাবে কমলাকান্ত দিবস পালন করেন।

নির্মল ঝিল আদি কালী : বর্ধমানের নির্মল ঝিল শ্মশানের কালীপুজো প্রায় ৬৫ বছরের পুরনো বলে স্থানীয় মানুষের দাবী। শ্মশান প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের ভাগ্না লালা নির্মলপ্রকাশ নন্দ। তাঁর নাম অনুসারেই শ্মশানের নাম হয় নির্মলঝিল। শ্মশান প্রতিষ্ঠার পর কালী প্রতিষ্ঠা হয়। কালীপুজোর রাতে খুব ধুমধাম করে এলাকার মানুষ মায়ের পুজো করে। এই পুজো উপলক্ষে বহু ভক্তের সমাগম হয়। মায়ের মূর্তিটি উত্তর মুখে অবস্থিত।

খোসবাগান খিন্নিতলা দীন সমিতির কালী: খোসবাগান শ্যামসায়র পাড়ে খিন্নিতলা দীন সমিতির কালী মায়ের প্রতিষ্ঠার সঠিক তথ্য জানা যায় না। শোনা যায় খিন্নি গাছের তলায় মায়ের পুজো হত। এ কারণেই মায়ের নাম খিন্নিকালী মা হয়েছে। পুজোর রাতে ছাগ ও ফল বলি হয়। এছাড়া দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়, বিসর্জনের দিন বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিসর্জন করা হয়। পুজোর কদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এই একই বেদীতে চৈত্র মাসে রক্ষা কালী পুজো হয়ে থাকে।