পূর্ব বর্ধমান জেলাজুড়ে নিয়ম ভেঙে নদনদী থেকে চলছে দেদার বালি চুরি, ঘোর সংকটের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা

Souris  Dey

Souris Dey

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: নদ, নদী থেকে বালি উত্তোলনের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুন্যাল থেকে রাজ্য সরকারের রয়েছে একাধিক নির্দেশিকা। তারপরেও রীতিমত সেইসব নির্দেশিকা কে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পূর্ব বর্ধমানের একদিকে গলসি থেকে পাল্লা অন্যদিকে খন্ডঘোষ থেকে জামালপুর দামোদর নদ জুড়ে অন্যদিকে অজয় নদের কাটোয়া, মঙ্গলকোট জুড়ে চলছে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কাজ। রীতিমত নদের মাঝখানে বালি তোলার নেট মেশিন বসিয়ে জেসিবি মেশিন দিয়ে দিন রাত নদীগর্ভ থেকে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তোলা হচ্ছে বালি।

বিজ্ঞাপন

জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তর সূত্রে জানা গেছে এই মুহূর্তে গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলায় মোট ৮৬ টি বালি ঘাটের বৈধ কাগজ রয়েছে। এর বাইরে যেখানে যে বা যারা নদ নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বালি তুলছে সেগুলো সব অবৈধ। বেআইনিভাবে চুরি করে বালি পাচার করছে তারা। এই সমস্ত অসাধু বালি কারবারিদের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই জেলা জুড়ে অভিযান চালানো হবে বলেই জানিয়েছেন জেলা ভূমি রাজস্ব আধিকারিক তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক ইউনিস রিসিন ইসমাইল।

এমনও দেখা যাচ্ছে যে এই বালি নদীর যে অংশ থেকে তোলা হচ্ছে সেই জায়গায় যাতে নদীর জল স্বাভাবিক ভাবে আসতে না পারে তার জন্য অনেক আগে থেকেই নদীর গতিপথ কৃত্রিম ভাবে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। তার জন্য বালি, মাটি দিয়ে নদীর একটা বড় অংশকে আটকে দেওয়া হয়েছে যাতে যে অংশ থেকে বালি তোলা হচ্ছে সেইদিকে জলের স্রোত না যেতে পারে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নদীর গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের অভিযোগ, দিনের পর দিন এইভাবে বালি কেটে পাচার করার ফলে নদী গর্ভে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশবিদদের মতে বর্ষার মরশুমে এইসব এলাকার আশপাশে বন্যার আশঙ্কার পাশাপাশি ইকো সিস্টেম নষ্টেরও আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

এমনই দৃশ্য দেখা গেছে পূর্ব বর্ধমানের রায়না থানার বাঁধগাছা এলাকার দামোদর নদের বুকে। যদিও নদের যে অংশ থেকে বালি তোলার কাজ চালাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বালি খাদান কর্তৃপক্ষ তাদের বালি তোলার অনুমতি নাকি রয়েছে বর্ধমান থানার অধীনে সদরঘাট মৌজায়। যদিও সদরঘাটের ৫ নম্বর পয়েন্টের যে জায়গা থেকে বালি তোলার কাজ চলছে সেই বালিঘাটের এক অংশীদার জানিয়েছেন, প্রশাসনের কাছে অনুমতি পাওয়ার পরই তারা বৈধভাবে বালি তোলার কাজ চালাচ্ছেন। তাদের কাছে পরিবেশ দপ্তরের শংসাপত্রও (environment clearance) রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই এরপর প্রশ্ন উঠছে কিভাবে নদীগর্ভে মেশিন নামিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দিনের পর দিন বালি তুলছে বালি কারবারিরা। সেক্ষেত্রে খোদ জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। খোদ গ্রিন ট্রাইবুন্যালের নির্দেশ অমান্য করে নদী গর্ভে নেট মেশিন নামিয়ে কিভাবে বৈধ বালি কারবারিরা বালি তুলে নিচ্ছে, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। অন্যদিকে সরকারিভাবে যে জায়গায় (প্লট/ব্লক) বালি তোলার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সেই নির্দেশ মানছে না ঘাট মালিকরা। কারণ সেই জায়গায় উৎকৃষ্ট মানের এবং পর্যাপ্ত বালি প্রায় শেষ। ফলে এক জায়গার চালান ব্যবহার করে অনুমোদনহীন নদীর অন্য জায়গা থেকে বালি কাটতে শুরু করে দিচ্ছে এক শ্রেণীর বালি কারবারিরা।

রাজ্য সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় একটি উৎস বালি। রাজ্য সরকার আয় বাড়াতে চাইলেও রাজস্ব আদায়কারীদের উদাসীনতার জন্য কোটি কোটি টাকার রাজস্ব লুটে নিচ্ছে বালি মাফিয়ারা বলেই অভিযোগ। পূর্ব বর্ধমানের খন্ডঘোষ, রায়না, জামালপুর, মেমারি, শক্তিগড়, গলসি, মঙ্গলকোট থানা এলাকার রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন শয়ে শয়ে চলছে অতিরিক্ত বালি বোঝাই ট্রাক, ডাম্পার। মাঝে মধ্যে পুলিশ ও ভূমি দপ্তরের অভিযানে বেশ কিছু বালির গাড়ি ধরা হলেও সামগ্রিক ভাবে সেটা অতি নগণ্য বলেই অনেকের মত। এছাড়াও বেআইনিভাবে বালি পচারের জন্য বালি কারবারিদের রয়েছে একাধিক ‘ সিস্টেম ‘। ফলে কোটি কোটি টাকার সরকারী রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে এমনটাই জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে রাজনৈতিক দলের নেতারা।

পূর্ব বর্ধমানের একদিকে গলসি থেকে পাল্লারোড অন্যদিকে খন্ডঘোষ থেকে জামালপুর – এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে দামদর নদী। যার মোটা বালি এখন সারা বাংলায় বিখ্যাত। স্বাভাবিকভাবেই এই বালি এখন ‘সোনা’। রাতারাতি কোটিপতি হতেই অবৈধ ভাবে নদীর যত্রতত্র থেকে দিনের পর দিন বালি পাচার শুরু করেছে এক শ্রেণীর অবৈধ বালি কারবারিরা। ফলে দিনের পর দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে দামদরের বুকে সরকারী কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এদের দৌরাত্ম্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে জনজীবন।

নদের কোন এক জায়গায় সরকারী ঘাটের অনুমোদন থাকলেই সেই ঘাট মালিকের ছত্রছায়ায় এসে ( অনেক ক্ষেত্রেই তারই চালান ব্যবহার করে) অনুমোদনহীন জায়গা থেকে বালি তুলে পাচার করে চলেছে। কোন কোন জায়গায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কম বেশি চারশো গাড়ি বালি লুট হয়ে যাচ্ছে দামোদর থেকে। বালি মাফিয়াদের একাংশ শাসক দলের ছত্রছায়ায় থেকে এই বেআইনি কারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। বালির গাড়ি যাতায়াতের ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রাস্তা, প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পরছেন সাধারণ মানুষ। তবুও প্রাণের ভয়ে কার্যত এই বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস দেখাতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।

আরো পড়ুন