ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে জটিল চিকিৎসা পরিষেবায় এক অনন্য বিরল নজির সৃষ্টি করল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে যমজ সন্তানের মধ্যে একটি শিশু অপরিণত অবস্থায় গর্ভেই মারা যাওয়ার পরেও বর্ধমান মেডিক্যালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় অন্য আরেকটি গর্ভস্থ শিশুকে টানা ১২৫ দিন পর্যবেক্ষণে রেখে অবশেষে মায়ের হাতে পরিণত সুস্থ পুত্র সন্তান কে তুলে দিলেন তাঁরা। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, বর্ধমান মেডিক্যাল তো বটেই, রাজ্য কিংবা দেশ ও বিশ্বেও এই আইএফবি (In Vitro fertilization) এর মাধ্যমে ‘ ডিলেড ডেলিভারি অফ সেকেন্ড টুইন ‘ ( delayed delivery of second twin) এর সময়ের নিরিখে (১২৫দিন) বর্ধমান মেডিক্যালের এই কৃতিত্ব গোটা দেশ তথা বিশ্বে প্রায় বিরল।
বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার কুলীনগ্রামের বাসিন্দা পম্পা প্রামাণিকের প্রথম থেকেই সন্তান প্রসবে সমস্যা ছিল। বর্তমানে তাঁর বয়স ৪১ বছর। প্রথম টেস্ট টিউব বেবি নেওয়ার প্রচেষ্টা ২০১৬ সালে ব্যর্থ হয়। তারপর কলকাতার বিভিন্ন নার্সিংহোম আর একাধিক ঠাকুরের মন্দিরে হত্যে দিয়েও কোন ফল হয়নি। চলতি বছরের মার্চ মাসে একইভাবে টেস্ট টিউবে মা হওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এবার তাঁর পেটে আসে যমজ সন্তান। কিন্তু, অন্তঃস্বত্তার ১৭ সপ্তাহে জুলাই মাসের ১১ তারিখ রক্তক্ষরণ নিয়ে তিনি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। গাইনি বিভাগে পরদিন অর্থাৎ ১২ তারিখ একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি।
এরপর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়। গর্ভে দ্বিতীয় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েন চিকিৎসকরা। কিন্তু, হাল ছাড়তে রাজি হননি তাঁরা। টানা ১২৫ দিন হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন তিনি। কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখা হয় মা ও শিশু কে। এরপর ১২৬ দিনের মাথায়, মঙ্গলবার তিনি যমজ সন্তানের দ্বিতীয়টির জন্ম দেন। শিশুটির ওজন হয় ২ কেজী ৯০৬ গ্রাম। মা ও সন্তান দুজনেই সুস্থ রয়েছে বলে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
বর্ধমান মেডিক্যালের দাবি, এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম। কিন্তু কেন এই দাবি? মেডিক্যালের গাইনি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মলয় সরকারের দাবি, জরায়ুতে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। তারপর অন্য আর একটি শিশুর জন্ম দেওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। কারণ, এই সময়ে সংক্রমণের ব্যাপক ভয় থাকে। এছাড়াও শিশুটির পরিনত হওয়ার সময়ও লাগে। তাই এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই অসাধ্যসাধন করেছে মেডিক্যাল। গত মার্চ মাসে আইভিএফ হওয়ার পর ১১ জুলাই প্রসূতি রক্তক্ষরণ নিয়ে ভর্তি হন বর্ধমান মেডিক্যালে। দুদিন পর অর্থাৎ ১৪ তারিখ শিশু দিবসের দিন সফলভাবে সন্তান প্রসব করেন মা। সিজার করে শিশুটি কে পৃথিবীর আলো দেখান চিকিৎসকরা।
এই গোটা প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকদের দশ জনের একটি টিম কাজ করে গেছেন নিরলস ভাবে। গাইনি বিভাগের মলয় সরকার ছাড়াও এস পি রায়চৌধুরী, দেবব্রত রায়, কৃষ্ণপদ দাস, অর্পিতা প্রামাণিক, শিশু বিভাগের চিকিৎসক মুকুট বন্দ্যোপাধ্যায়, এনেস্থেশিয়া বিভাগের সুমন্ত ঘোষ মৌলিকদের নিয়ে মেডিক্যাল টিম এই কাজ করেন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার ডা: তাপস ঘোষ বলেন, ‘ আমাদের চিকিৎসকরা অসাধ্যসাধন করেছেন। এটা আমাদের কাছে গর্বের দিন। দেশ তথা বিশ্বে এই ধরণের ঘটনা খুব কমই হয়েছে বলে জেনেছি।’
এই বোর্ডের দাবি, ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর শহরে এই ধরণের একটি ঘটনায় ৯০ দিন পর দ্বিতীয় শিশুটিকে সফলভাবে প্রসব করানো হয়। এই ঘটনা গিনেস বুক অফ রেকর্ডস এ আছে। বর্ধমান মেডিক্যালে তাঁরা ১২৫ দিনের পর প্রসব করিয়েছেন। তাদের ধারণা পূর্বের সাফল্য এবং রেকর্ড ছাপিয়ে গেছেন তাঁরা। শিশুর পিতা অনুপ প্রামাণিক জানান; ‘শিশু দিবসের দিনে অভাবিত ভাবে ছেলেকে পেলাম।আমি ডাক্তার দেবু স্যারের যদি কোনো ভাল নাম থাকে সেই নামেই ছেলের নাম রাখব। যাতে সারাজীবন এই পাওয়াটা স্মরণে থাকে। আমি প্রথমে চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু যেভাবে ওরা সেবা দিয়েছেন তা বাড়িতে রেখে সম্ভব ছিল না।’ স্বাভাবিকভাবেই বর্ধমান মেডিক্যালের এই ধরণের একটি সাফল্য নতুন আশা যোগাচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে যুক্ত মানুষেরা।