ক্রাইম

গলসিতে ভরা বর্ষাতেও চলছে দামোদর থেকে বালি লুট, পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে সেটিংয়ের অভিযোগ

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক, গলসি : জেলার নদ নদী থেকে বর্ষাকালে বালি তোলার ব্যাপারে পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রশাসন প্রায় এক মাস আগেই নির্দেশিকা জারি করেছে। কিন্তু তারপরেও গলসি থানার অন্তর্গত দামোদর নদের তীরবর্তী গোহগ্রাম থেকে সুন্দলপুর পর্যন্ত রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় নদী থেকে বালি তুলে এনে মজুদ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। পরে সেই মজুদ বালি ডাম্পার ও ট্রাক্টরের মাধ্যমে বিনা চালানে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৫০থেকে ১০০গাড়ি বালি বিনা চালানে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্লক ভূমি রাজস্ব দপ্তর বা পুলিশ কেউই এই বেআইনি কারবার বন্ধে উদ্যোগী নয় বলেই অভিযোগ করছেন স্থানীয় গ্রামবাসীদের একাংশ।

 

গোহগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েত উপপ্রধান কানন মাঝি অভিযোগ করেছেন, ‘ দিনের পর দিন এই এলাকার দামোদর নদ থেকে কিছু অসাধু ব্যক্তি বালি চুরি করে রাস্তা ও বাঁধের ধারে মজুদ করছে অবৈধভাবে। রাতের অন্ধকারে সেই বালি ছ চাকা, দশ চাকা থেকে ট্রাক্টরের মাধ্যমে লোড করে পাচার করে দিচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা সরকারের চুরি যাচ্ছে। ব্লক ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিক থেকে গলসি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার কে বারবার এই বেআইনি কারবার বন্ধ করার ব্যাপারে জানালেও কেউই এব্যাপারে সদিচ্ছা দেখাচ্ছেন না। ফলে এলাকার মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।’ স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয়দের অনেকেই প্রশ্ন তুলছে, তাহলে কি সেটিং করেই চলছে ওই কারবার? উপপ্রধান জানান, এলাকার পারাজ-শিল্ল্যা এবং গলসি-গোহগ্রাম রাস্তার ধারে এখন চলছে রমরমিয়ে বালি ব্যাবসা। তার কথায় প্রতিদিন নদীর চর থেকে কয়েকশো ট্রাক্টরে করে বালি তুলে গোহগ্রাম থেকে সুন্দলপুর পর্যন্ত দামোদরের বাঁধে এবং পিডব্লিউডির  রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে প্রতিদিন কমবেশি পঞ্চাশ গাড়ি বালি পাচার হচ্ছে জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়।

প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে তাহলে কি পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে এই বালি মাফিয়াদের কোন সেটিং রয়েছে? টাকার বিনিময়ে চলছে ওই কারবার? কাদের মদতে এই বেআইনি কারবার চালানোর সাহস পাচ্ছে বালি মাফিয়ারা? গলসির চৌমাথা সহ বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। বালি বোঝাই বিনা চালানে ট্রাক্টর বা ডাম্পার গলসি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুলিশের নজরদারিতে সেইসব আসছে না ! উপপ্রধান জানিয়েছেন, জেলা পুলিশের আধিকারিকরা ও জেলার ভুমি রাজস্ব দপ্তরের অফিসারেরা প্রয়োজনে সিসি টিভি ফুটেজ চেক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

যদিও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বালির বেআইনি কারবারের বিষয়ে অভিযোগ পেলেই অভিযান চালানো হয়। তবে অনেকক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই অবৈধ বালি কারবারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা গা ঢাকা দেয়। এরপরেও নিয়মিত অভিযান চালানো হয় থাকে। তবে এলাকাবাসীদের অনেকেই জানিয়েছে, বালি মাফিয়াদের নিজস্ব একটা সিস্টেম আছে, তার মধ্যে অন্যতম ‘ লোকেশন টিম ‘ নেটওয়ার্ক। এরাই মূলত পুলিশ বা ভূমি দপ্তরের অভিযান সম্পর্কে আগাম খবর পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। ফলে পুলিশ বা প্রশাসনের অধিকারীকেরা অভিযানে গেলেও বেশিরভাগ সময়ই খালি হাতেই ফিরতে হয়। 

উপপ্রধান জানান, বেআইনি এই বালি কারবার নিয়ে একাধিকবার পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানালেও মোট কথা তারা এসব কর্নপাত করেন না। যদি করতো তাহলে এই অবৈধ বালি কারবারিরা বুক ফুলিয়ে দিনের পর দিন বালি চুরি করতে পারতো না। আর সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব লুট হতো না। কিন্তু পুলিশই হোক বা ব্লক ভূমি রাজস্ব দপ্তর, অদৃশ্য কারণে কেউই এই বেআইনি কারবার বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেয় না। তাই ভরা বর্ষাতেও প্রশাসনের নির্দেশ কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেদার চলছে নদী থেকে বালি লুট। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, পুলিশ ও প্রশাসন এই অবৈধ কারবারের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে নাকি তাদের ‘ বখরা ‘ বন্ধ হয়ে যাবে। তা না হলে স্থানীয় প্রশাসন কেন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না এই বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম বন্ধে?

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবী, গলসির দামোদরের বালি নাকি একদম সোনা। আর এই সোনা লুট করতে ’ সেটিং ‘ হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে এলাকার বালি মাফিয়াদের। তাদের দাবী, সরকারি রাজস্ব আদায় করা এদের লক্ষ্য নয়। নিজেদের পকেট ভরানোই এখানে লক্ষ্য। ফলে সরকারেরই ক্ষতি করছেন খোদ সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশ। তাদের দাবী, অবিলম্বে বন্ধ হোক এইভাবে সরকারি সম্পদ লুট।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, গলসির গোহগ্রামের কাছে দামোদর নদীর জল এখন দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ বাঁকুড়া দিকে বইছে। ফলে গলসির গোহগ্রামের দিকে চর গুলি এখনও প্লাবিত হয়নি। সেখানে মজুত রয়েছে মোটা লাল বালি। যা এখনও টেন্ডার হয়নি। বালি মাফিয়ারা বাঁকুড়ার পাত্রসায়র থানার শালখাড়া মৌজা ও ইন্দাস থানার হাবিবপুর মৌজার দামোদর নদ থেকে বালি চুরি করে নিয়ে আসছে। সেই বালি খুবই মুল্যবান বলে ধারনা অনেকের। আবার গলসি থানার তাহেরপুর থেকে পুরতান গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাক্টর নামিয়ে তোলা হচ্ছে ওই মোটা বালি। এলাকার আমতলা ঢাল, বোম ঘাট, সোনার বাংলা ঢাল, আদর্শ সিন্ডিকেট ও সোজা ঘাটের ঢাল ব্যবহার করা হচ্ছে বালি তোলার জন্য।

সেই বালি পুরাতন গ্রামের বন্যবুড়ি তলা থেকে সুন্দলপুর গ্রামের মোড় পর্যন্ত ও রামগোপালপুর মোড় থেকে জাগুলি পাড়ার মোড় পর্যন্ত রাস্তার ধারে মজুদ করে রাখা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর কমবেশি পঞ্চাশটি গাড়িতে বালি লোড করে বিনা চালানে পাচার করছে মাফিয়ারা। স্থানীয়দের অনেকে জানিয়েছেন, ঘাট থেকে ৪০০টাকা লোডিং খরচ দিয়ে সেই বালি ২হাজার থেকে ২২শো টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা মুনাফা লুটছে বালি মাফিয়ারা। সব জেনেও না জানার ভান করে যাচ্ছে প্রশাসন, এমনই অভিযোগ তুলছেন অনেকেই। স্থানীয়দের দাবী, পুলিশ ও বিএলআরও সক্রিয় ভুমিকা পালন করলে বাস্তবে সরকারের এই সম্পদ লুট করার সাহস কেউ দেখাতে পারতো না।