---Advertisement---

সম্প্রীতির সংকটে সমাজ: বিভেদের রাজনীতির বিপরীতে মানবিকতার ডাক

Souris Dey

Published

দেবরাজ সাহা: “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান। মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥ এক সে আকাশ মায়ের কোলে যেন রবি শশী দোলে, এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥”

বিজ্ঞাপন

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের এই পঙক্তিগুলো কেবল কবিতা নয়, এক অনন্ত মানবিকতার আহ্বান। এই আহ্বান আজও সময়ের প্রেক্ষিতে যথার্থ, বরং আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ, আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যখন মানুষের ধর্মীয় পরিচয় তার মানবিক পরিচয়কে ছাপিয়ে যাচ্ছে। সমাজে তৈরি হচ্ছে অদৃশ্য বিভাজনের রেখা, যেখানে মানুষকে ‘আমরা’ আর ‘তারা’—এই দুই ভাগে আলাদা করা হচ্ছে।

ধর্ম, যা হাজার বছর ধরে মানুষের আত্মিক উন্নয়ন, নৈতিকতা ও সহমর্মিতার পথ দেখিয়েছে, সেই ধর্ম আজ একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। রাজনীতির এই কৌশল সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি সমাজের নীরব অংশও যেন এখন এসব বিভেদের শিকারে পরিণত হচ্ছে। কোথাও কোথাও ধর্মীয় পরিচয় হয়ে উঠছে বিশ্বাসের একমাত্র মাপকাঠি, যা একসময় বিশ্বাস ছিল ব্যক্তিত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর। ধর্মীয় বিভাজন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে এমনভাবে, যেন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অন্য একটি গোষ্ঠীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বিভাজনের পেছনে রয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার, ভুল তথ্য এবং ভয়ভীতি ছড়িয়ে সমাজকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি আরও তীব্র রূপ পেয়েছে। মিথ্যা তথ্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব ও ঘৃণামূলক পোস্ট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে—কে বন্ধু, কে শত্রু, সে বিচার যেন এখন ধর্মের ভিত্তিতে। এক সময়ের যে সমাজ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে গর্ব করত, সেই সমাজেই এখন প্রশ্ন উঠে—কে কাকে বিশ্বাস করবে? কে কাকে সহযোগিতা করবে? অথচ এই অবিশ্বাসের চাষাবাদ এককভাবে রাজনীতির মাধ্যমে সম্ভব হতো না, যদি না সমাজের একটি বড় অংশ নির্বিকার থাকত অথবা নিজের ভেতরেই সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করত।

See also  পুরসভার নতুন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানের নাম চূড়ান্ত! ঘোষণার অপেক্ষা

প্রশ্নটা এখানেই — সব দায় কি কেবল রাজনীতির? সমাজের কি কোনো দায় নেই এই অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরির জন্য?
আমরা যদি নিজেদের আয়নায় দেখি, তবে দেখতে পাব—এই বিভাজনের পেছনে রয়েছে আমাদের অসচেতনতা, অজ্ঞতা এবং নীরব সমর্থন। যখন মানুষ কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে অন্যকে বিচার করে, তখন সে নিজেই একটি অসহনশীল সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে। একটি অসহিষ্ণু সমাজে সম্পর্কের জায়গায় তৈরি হয় শত্রুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গায় গড়ে ওঠে ঘৃণা। এই সংস্কৃতি কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট করে না, বরং সামগ্রিকভাবে একটি জাতির অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করে। কারণ উন্নয়নের প্রধান শর্ত হলো সামাজিক স্থিতি ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা—যা এই বিভাজন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

বাংলার ইতিহাস সাক্ষী, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান একত্রে যুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার জন্য, সংগ্রাম করেছে ন্যায়ের পক্ষে, আর উৎসবে একে অপরের পাশে থেকেছে। ঈদে দেখা গেছে হিন্দু পরিবার রসগোল্লা নিয়ে হাজির, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম বন্ধু হাতে প্রসাদ তুলে দিয়েছে। ছোট ছোট গ্রাম আর মহল্লায় বহু বছর ধরে এমনই সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে—যেখানে ধর্ম নয়, মানুষ বড়। কিন্তু আজ সেই ঐতিহ্য হুমকির মুখে। ভয় হয়, এই ঐতিহ্য কি হারিয়ে যাবে রাজনীতির ছলনায়?

তবে হতাশার মাঝে আশার আলো এখনো রয়েছে। সমাজের বিভিন্ন অংশে এখনো অনেক মানুষ ও সংগঠন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সম্প্রীতির সংস্কৃতি বজায় রাখতে।
বিভিন্ন স্থানে আন্তঃধর্ম বৈঠক, সম্মিলিত উৎসব, মানবিক সহযোগিতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে মানুষ এগিয়ে আসছে। এসব উদ্যোগ প্রমাণ করে, সব মানুষ বিভেদের পক্ষে নয়; এখনও অনেকেই বিশ্বাস করে—মানবিকতা ধর্মের ঊর্ধ্বে। একটি সমাজে যদি মানুষ একে অপরকে সহ্য করতে শেখে, একসঙ্গে চলতে শেখে, তবে উন্নয়ন, শান্তি এবং স্থিতিশীলতা—সবকিছুই সম্ভব। কারণ সম্প্রীতির সংস্কৃতি কেবল সামাজিক সৌহার্দ্য নয়, এটি একটি উন্নত সমাজের ভিত্তি।

See also  এবার আক্রান্ত ভাতার ও মঙ্গলকোটের দুই যুবক, জেলা জুড়ে নতুন করে চাঞ্চল্য

আজ আমাদের সামনে দুটি পথ—একটি বিভাজনের, অন্যটি সম্প্রীতির। আমরা কী বেছে নেব, সেটিই নির্ধারণ করবে আমাদের সমাজ কোন দিকে যাবে। বিভেদের রাজনীতি আমাদের টেনে নিয়ে যাবে এক দুঃসহ ভবিষ্যতের দিকে; আর সম্প্রীতির সংস্কৃতি আমাদের নিয়ে যাবে এক মানবিক সমাজের দিকে। আমাদের এখন প্রয়োজন সেই মানবিক মূল্যবোধকে আরও শক্ত করে ধরা, যা কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছিলেন—“মানুষ সবচেয়ে বড় পরিচয়।” সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি সে পরিচয়কে সম্মান দিতে শেখে, তাহলেই সম্ভব হবে একটি সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা—যেখানে ধর্ম নয়, মানবতা হবে আমাদের পরিচয়।

শেয়ার করুন 🤝🏻

Join WhatsApp

Join Now
---Advertisement---