প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর বর্ধমান আজও রাজ্য কিংবা দেশের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করতে পারল না, আক্ষেপ সব মহলে

Souris  Dey

Souris Dey

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: ইতিহাসের উদ্দেশ্যই হলো বর্তমানের সাথে অতীতকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। পাশাপাশি ভবিষ্যত কেও প্রভাবিত করা। তাই ইতিহাস কে সংরক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখলে বর্তমান ও ভবিষ্যতও একদিন ফের ইতিহাস তৈরির উপাদান হয়ে ওঠে বলেই মত প্রকাশ করেছেন ইতিহাসবিদগণ। বর্তমানে ‘হেরিটেজ’ বিষয়ে খুব চিৎকার শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে হেরিটেজ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার আদৌ তেমন কিছুই পরিবর্তন হয়নি বলেই ইতিহাসবিদ দের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন, হেরিটেজ মানেই একটা জগদ্দল পাথর, যাকে আর নড়ানো যাবে না। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বরং হেরিটেজ চরিত্রের বদল না ঘটিয়েই তা ব্যবহার করা সম্ভব বলেই জানিয়েছেন ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। 

বিজ্ঞাপন

প্রাচীন জনপদ বর্ধমান একটি ঐতিহাসিক শহর। এই শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন। যেগুলো কয়েকশো বছর ধরে আজও বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। তবু এই ইতিহাস কে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বর্ধমান পুরসভার তেমন কোন উদ্যোগ নেই বলেই আক্ষেপ করেছেন শহরবাসীর একাংশ। বাম আমলে বর্ধমান পৌরসভার একটি হেরিটেজ কমিটি ছিল, যার উদ্যোগে বেশ কিছু হেরিটেজ স্থাপত্য ও বস্তুর সংস্কার ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তারপর দীর্ঘদিন এই কমিটির আর কোন অস্তিত্বই নেই। ফলে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রীতিমত ভাটা পড়েছে বলে অভিযোগ।

এরই পাশাপাশি বর্ধমান শহরের ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও ভবনগুলোর যেগুলি ইতিমধ্যেই হেরিটেজের তকমা পেয়েছে, তাদের কোনো সম্পূর্ন তালিকা না থাকায় নিয়মিত নষ্ট হচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে সেইসব নিদর্শন বলে জানিয়েছেন ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন এমন একাধিক ব্যক্তি। এমনকি তাঁদের অভিযোগ, ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে এই ঐতিহাসিক শহরের চরিত্র। বর্ধমান হেরিটেজ আসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক ড. সর্বজিৎ যশ বলেন, “এক্ষুনি যদি প্রশাসন এই ব্যাপারে উদ্যোগী না হয়, তবে এই প্রাচীন, ঐতিহাসিক শহরটা অদূরেই হারিয়ে গিয়ে হয়ে উঠবে শুধুমাত্র ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গল। এই বিষয়ে প্রশাসনের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা একাধিকবার প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হেরিটেজ কমিটি তৈরী এবং হেরিটেজ ম্যানুয়াল তৈরির আবেদন করেছি, কিন্তু কোনোও সদুত্তর পাইনি।”

সর্বজিত বাবু বলেন,” হেরিটেজের সংরক্ষণ নিয়ে কমিশনের নির্দিষ্ট গাইড লাইন রয়েছে। হেরিটেজের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন না করে কিভাবে তার রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা যায় তারও নির্দেশিকা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অনেক সময়ই লক্ষ্য করা যাচ্ছে হেরিটেজ স্থাপত্যের সংস্কার করতে গিয়ে সেটির চরিত্রগত নিদর্শনের পরিবর্তন ঘটছে। স্বাভাবিকভাবেই সংকটের মুখে পড়ছে ঐতিহাসিক স্থাপত্য। আবার অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের গুরুত্ব বুঝতে না পেরে দীর্ঘদিন তার কোনো সংস্কার হয়না। ফলে কার্যত অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে সেই সমস্ত প্রাচীন ঐতিহাসিক নির্দশন। অবিলম্বে এই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত প্রশাসনের।”

বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান তথা বর্ধমান পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান আইনুল হক বলেন,” বর্ধমান শহর একটি প্রাচীন জনপদ। এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই এই শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। স্থাপত্য। প্রত্যেক দেশেই তাদের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। এরআগে বর্ধমান পুরসভার এবং রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের যৌথ উদ্যোগে একাধিক হেরিটেজ স্থাপত্যের সংস্কার করা হয়েছিল।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই সময় রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের একজন সদস্য হওয়ার। সেই সময় বর্ধমানের ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য পুরসভায় একটি কমিটিও তৈরি করা হয়েছিল। এই কমিটি পর্যবেক্ষণ করে একটা লিস্ট তৈরি করেছিল কোন কোন স্থাপত্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার দরকার। সেই অনুযায়ী হেরিটেজ কমিশনের সহযোগিতায় কার্জন গেট, কংকালেশ্বরী কালি মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, শের আফগানের সমাধি, জোর বাহার মন্দির, বারোদুয়ারী, নূরজাহান গেট, জুম্মা মসজিদ, প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ, টাউন হল, সর্বমঙ্গলা মন্দির ইত্যাদির সংস্কার করা হয়েছিল। এছাড়াও আরো অনেক স্থাপত্য রয়েছে যেগুলোর কোনো সংস্কার আজও করা হয়নি। কিছু স্থাপত্যের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা থাকলেও বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপত্যের অবিলম্বে সংরক্ষণ ও রক্ষণেক্ষণ প্রয়োজন।”

আইনুল হক বলেন,” হেরিটেজ স্থাপত্যের রক্ষণাবেক্ষণ করার নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। হেরিটেজের মূল কাঠামোর কোনো চরিত্রগত পরিবর্তন করা যায় না। অর্থাৎ যে বস্তু বা পদার্থ দিয়ে সেই স্থাপত্য তৈরি করা হয়েছিল, সংস্কারের সময় সেই সমস্ত বস্তুই ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ভালোও করা যাবে না, আবার খারাপও করা যাবে না। এমনকি সংস্কারের পর হেরিটেজ স্থাপত্যের গায়ে কোনো ফলকও লাগানো যায় না।”

আইনুল বাবু বলেন,” ঐতিহাসিক বর্ধমান শহরকে রাজ্য তথা দেশের পর্যটন মানচিত্রে তুলে নিয়ে আসতে একসময় পুরসভা একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। প্রাচীনকাল থেকে সমস্ত ধর্মের মানুষের বাসস্থান এই বর্ধমান শহর। সমস্ত ধর্মের মানুষের মিলনক্ষেত্র ও ঐতিহাসিক এই শহরের ইতিহাস কে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দিতে শুরু করা হয়েছিল ‘বর্ধমান উৎসব’। তবু আমাদের আক্ষেপ, সরকারি স্তরে এখনও বর্ধমান কে দেশের বা রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। বর্ধমানে যে সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। এদের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ এর দায়িত্ত্ব আমাদের। সুতরাং এইসব রক্ষা করতে সকলকেই আরো উদ্যোগী হতে হবে।”

বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান, পরেশচন্দ্র সরকার বলেন, ” বর্ধমান শহরের ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও নিদর্শনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ নিয়ে বর্ধমান পুরসভা সর্বদাই সচেতন রয়েছে। খুব শীঘ্রই শহরের বিশিষ্ট নাগরিক, ইতিহাসবিদ, প্রশাসনের লোকজনদের নিয়ে একটি হেরিটেজ কমিটি গঠন করার চিন্তা ভাবনা রয়েছে। দুবছর করোনার কারণে আমরা বর্ধমান উৎসব এর আয়োজন করতে পারিনি। এবছর আমরা নতুন ভাবনায় এই শহরের ঐতিহ্যগুলোকে কিভাবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা শুরু করেছি।”

আরো পড়ুন