ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই পূর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তের জলাশয়, খাল বিল, নদ নদী এমনকি জলাশয়ের তীরবর্তী এলকাজুড়ে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি ভিড় করতে শুরু করেছে। সুদূর হিমালয়ের উপর দিয়ে বিভিন্ন দেশের সীমানা টপকে কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে এই সমস্ত পরিযায়ীরা তাদের নতুন ঠিকানার খোঁজে ভিড় করছে এই সমস্ত জলাশয়ে। মূলত খাদ্যের খোঁজে ও প্রজননের তাগিদে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে এই পাখিরা উড়ে আসে প্রতিবছর। ফ্রেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এরা এই এলাকায় সংঘবদ্ধ ভাবে থাকে। তারপর আবার ফিরে যায় নিজের নিজের দেশে।
গত কয়েকবছর ধরে বন বিভাগের উদ্যোগে একাধিক পশুপক্ষী প্রেমী সংস্থার ও এনজিওর সহযোগিতায় জেলা জুড়ে পরিযায়ী পাখি গণনার কাজ করা হচ্ছে। করোনার কারণে দুবছর এই গণনা স্থগিত থাকার পর চলতি বছরের প্রথমে শীতের সময় ফের এই পাখি গণনার কাজ করা হয়েছিল। সেই সময় মূলত পূর্বস্থলীর চুপিচর, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, আউশগ্রাম, ভাতার ইত্যাদি এলাকার জলাশয়ে আসা পরিযায়ীদের উপর সমীক্ষা চালানো হয়। যদিও দামোদর তীরবর্তী পাল্লারোড, বড়শুল, চৈত্রপুর, শ্রীরামপুর, সদরঘাট ও ইদিলপুর এই সমস্ত এলাকায় পরিযায়ীদের গণনা হয়নি। আর এইবার এই এলাকা গুলোতেও পরিযায়ী পাখিদের গণনার কাজ করা হবে বলেই জানিয়েছেন বিভাগীয় অতিরিক্ত বনাধিকারিক সোমনাথ চৌধুরী।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গতবছর পূর্ব বর্ধমান জেলায় প্রায় ১০৩ টি বিভিন্ন প্রজাতির দেশি বিদেশি মিলিয়ে মোট ১৫হাজার ১৮৪ টি পাখি এসেছিল। এদের মধ্যে করজগ্রাম এলাকার বিভিন্ন জলাশয়ে ১৯ টি প্রজাতির মোট ৮১৬ টি পাখির খোঁজ পাওয়া গেছে। খিরজগ্রামে ২০টি প্রজাতির ১০৩১টি পাখির দেখা পাওয়া গেছে। আউশগ্রামের কালিকাপুরে ২৭টি বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৯৪৬ টি পাখি দেখা গেছে। ভোতার বিলে ৪৩ টি প্রজাতির ৮৭২ টি পরিযায়ী পাখির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। উড়াল বিলে ৫৪ টি প্রজাতির ৬৫০টি পাখি কে দেখতে পাওয়া গেছে। অন্যদিকে জেলার মধ্যে সর্বাধিক পুর্বস্থলির চুপি চরে ৫৪ টি প্রজাতির ৮৫৪৬ টি পরিযায়ী পাখি গণনায় ধরা পড়েছে। পাশাপশি আহার বিলে ২১ টি প্রজাতির ৫০৩টি পাখি, কয়না বিলে ২০টি প্রজাতির ৪৬১টি, শ্রীরামপুর বিলে ২০টি প্রজাতির ৪৫৩টি, ছাতার দীঘি তে ২০টি প্রজাতির ৩২১টি ও সায়ের পাড় দীঘিতে ২টি প্রজাতির পরিযায়ী পাখি প্রায় ৫৮৫ টির হদিস পাওয়া গিয়েছিল।
অতিরিক্ত বনাধিকারিক সোমনাথ চৌধুরী বলেন,’ আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এবছর শুরু হবে পাখি গণনার কাজ। সেক্ষেত্রে গতবারের তুলনায় এবছর পরিযায়ী পাখির সংখ্যাও অনেক বাড়বে। এবার এই পাখি গণনার এলাকা হিসেবে নতুন করে সংযোজন হবে বর্ধমানের দামোদর নদের পাল্লারোড থেকে ইদিলপুর পর্যন্ত এলাকা। ইতিমধ্যে আমাদের কাছে খবর এসেছে দামোদর নদের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রচুর পরিযায়ী পাখি এসেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংস্থা ও এনজিওর মাধ্যমে আমাদের বন কর্মীরা এই এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছেন। আশা করা যাচ্ছে এবছর পূর্ব বর্ধমান জেলায় পরিযায়ী পাখির আসার সংখ্যা অনেকটাই বাড়বে।’
বর্ধমানের পশুপ্রেমী সংস্থা সোস্যাইটি ফর এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার এর সদস্য অর্ণব দাস জানিয়েছেন, বর্ধমানের হাটশিমুল এলাকা থেকে বরশুলের কাছে দামোদরের চর বরাবর গত কয়েকবছর ধরে প্রচুর দেশি বিদেশি পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, কয়েকবছর আগেও এই পাখিরা এখানে আসতো, কিন্তু চোরা শিকারিদের উপদ্রবে ধীরে ধীরে পরিযায়ীদের এই এলাকায় আসা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমতে শুরু করেছিল। আর এরপরই সংস্থার উদ্যোগে কয়েকজন নদের ধারে বসবাসকারী মানুষ, মাঝি, জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এই চোরা শিকারিদের কিভাবে আটকানো যায় তার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রচেষ্টা টানা বছর তিনেক চালানোর পর অবশেষে গত বছর থেকে ফের পরিযায়ীরা তাদের পুরোনো আস্তানায় ফিরতে শুরু করে। এবছর তো সময়ের আগেই বেশ কিছু প্রজাতির পাখি দামদের সংলগ্ন চৈত্রপুর, শ্রীরামপুর প্রভৃতি এলাকায় এসেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
অর্ণব দাস জানিয়েছেন, প্রধানত দামোদর নদের বালির চরে আটকে যাওয়া বা জমে থাকা জলের ধারেই এই পরিযায়ীরা ভিড় করে। তবে জলের ধারে ঝোঁপ ও গাছ গাছালি ঘেরা এলাকাতেও পরিযায়ীরা আস্তানা বাঁধছে। মূলত জলের শ্যাওলা, গেরী, গুগলি বা ছোট পোকামাকড় এই পাখিদের প্রধান খাদ্য। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের সংস্থা এবং এলাকার মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন যাতে পরিযায়ীদের আনাগোনা এই এলাকায় আরো বাড়ে। তিনি জানিয়েছেন সম্প্রতি দামোদরের জলে কয়েকটি পরিযায়ী পাখির মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। প্রশাসন এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এলাকায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে লাগাতার প্রচারও চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি চোরা কারবারি বা পাখি শিকারিদের আটকাতেও তাঁরাও বদ্ধপরিকর বলে অর্ণব জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মানুষ সচেতন হলে এই এলাকাই একদিন বিশ্বের পাখিদের জন্য সেরা ঠিকানা হয়ে উঠতে পারে।
অর্ণব দাস জানিয়েছেন, প্রধানত দামোদর নদের বালির চরে আটকে যাওয়া বা জমে থাকা জলের ধারেই এই পরিযায়ীরা ভিড় করে। জলের শ্যাওলা, গেরী, গুগলি বা ছোট পোকামাকড় এই পাখিদের প্রধান খাদ্য। তিনি জানিয়েছেন, নভেম্বরের শুরু থেকে এই পরিযায়ীদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। আগামী ফ্রেব্রুয়ারীর শেষ কিম্বা কোনোকোনো সময় মার্চ মাস অবধি এই পরিযায়ীরা দামোদরের বুকে থেকে যায়। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের সংস্থা এবং এলাকার মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন যাতে পরিযায়ীদের আনাগোনা এই এলাকায় আরো বাড়ে। পাশাপাশি চোরা কারবারি বা পাখি শিকারিদের আটকাতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মানুষ সচেতন হলে এই এলাকাই একদিন বিশ্বের পাখিদের জন্য সেরা ঠিকানা হয়ে উঠতে পারে।
অর্ণব দাস জানিয়েছেন, গতবছর আমাদের জেলায় শতাধিক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি বিভিন্ন জলাশয়ে বাসা বেঁধেছিল। এবছরেও ইতিমধ্যে তাদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে জেলার নানান প্রান্তে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রুডিশেল হাঁস (চখাচোখী) তিব্বত, প্যাটিনকোল (বাবুই বাতান) আপার হিমালয়, ওসপ্রে (মাছ ঈগল) সাইবেরিয়া, গাদওয়াল (পিয়াং হাঁস) চিন, লাল ক্র্যাস্টেড পোচার্ড (রাঙা মুড়ি), নর্দার্ন পিনটেইল (উত্তরে লেজ হাঁস) তিব্বত, রিভার ল্যাপউইং (নদি টি টি) তিব্বত, গ্রেটার করমোরেন (বড় পানকৌরি) উত্তরবঙ্গ, গ্রে থ্রোটেড মার্টিন (খয়রি গলা নাকুটি) পূর্ব হিমালয়, কমন হুপো (হুদহুদ, ইসরায়েল এর জাতীয় পাখি) , কলার্ড প্যাটিনকোল (কণ্ঠি বাবুবাতান) হিমালয়, ওরিয়েন্টাল ডাটার (রাজস্থান), ডানলিন- উত্তরবঙ্গ। সাইবেরিয়ান রুবি থ্রোট (লাল গলা ফিদ্দা,), নীল থ্রোট (নিল গলা ফিদ্দা) সাইবেরিয়া, গ্লসি আইবিস, ব্ল্যাক হেড আইবিস (কালো মাথার কাস্তে চোরা) আফ্রিকা, সরাল পাকিস্তান, ব্ল্যাক হেডেড বান্টিং (রাশিয়া) তাইগা ফ্লাইক্যাচার, ইউরো এশিয়ান রেইনেক (মেঠো কাঠ ঠোকরা), প্লাম হেডেড পেরাকিট ( টিয়া) শ্রীলঙ্কা, কমন রোজ ফিঞ্চ, হিমালয়ের উপরিঞ্চল। এদের অনেকেই দামোদরের চড়ে ভিড় জমিয়েছে।