ঋষিগোপাল মণ্ডল: গাছ ভাগান এসি লাগান প্রকল্পে রাজ্য টা ‘ম ‘ম করছে। আপনি দয়াময় পাঠক, মাঈ বাপ, এ রাজ্যে ‘ম’-এ কী বা কী কী হয় তা তো বিলক্ষণ জানেন। বোঝেন। যাজ্ঞে সে কথা! মোদ্দা কথাটা হচ্ছে ৪২-৪৩ নিয়ে। ডি.এ. নয়। গরম নিয়ে। গরমের সঙ্গে উন্নয়নের আর উন্নয়নের সঙ্গে বৃক্ষ নিধনের বেশ একটা মাখো মাখো রিলেশন আছে। রিলেশনটা পারস্পরিক। দেশে, এই রাজ্যে উন্নয়ন হলেই গরম বাড়ে। এটা উন্নয়নের গরম।
এখানে কর্তাদের ও কর্তাভজাদের কারা যেন বুঝিয়েছে , উন্নয়ন ইকোয়াল টু টুনির মা এবং তার চোদ্দ গুষ্টির জন্য ঝিলিমিলি টুনিবাল্ব, বাড়ন্ত বাচ্চাদের জন্য হাইরাইজ, উড়ন্ত সেতু, ঝুলন্ত ব্যালকনি, দুরন্ত হাইওয়ে। হাইওয়ের আবার ৪/৬ টি পাখনা। মানে, লেন। ফোর লেন। সিক্স লেন। এত উন্নয়ন করতে হলে তো গাছ কাটতেই হয়। আর গাছ কাটা পড়লে তো গরম বাড়বেই।
গরম বাড়ার, তাপ প্রবাহের নানা কারণ, যুক্তি আছে। পরিবেশবিদরা সেগুলি নিয়ে সবিস্তার বলতে পারবেন। তবে উন্নয়ন হলে গাছ, জঙ্গল, ঝোপ ঝাড় কাটা পড়ে, আই মিন, পড়বেই সে কথা তো আমি আপনি সে ও সখা…সকলেই জানি। দেখি। পুকুর, ডোবা, জলাশয় মায় নদীও দিনে দুপুরে চুরি হয়ে যায় সেকথা তো আপনার অজানা নয় কদরদান মেহেরবান সাহেবান…
তাহলে যোগ বিয়োগ করে দাঁড়ালো: উন্নয়ন = বৃক্ষ নিধন = গরম। এমন সহজ সমীকরণ মানতে মন চাইছে না ? সরলীকরণ হয়ে গেল ? বেশ। একদিন সময় করে বর্ধমানের গোলাপবাগ চত্ত্বর, রমনা বাগান, বিজয়বাহারের আশেপাশে ঘুরে যান। অবশিষ্ট বর্ধমানের চেয়ে ওখানে দেড়/দুই ডিগ্রি গরম কম না হলে আমায় পাঁচুগোপাল বলে পুষবেন। আপত্তি করবো না।ওখানে গাছ বেশি। গরম কম। তাপ কম। অক্সিজেন বেশি। এসব জানা-বোঝার জন্য পরিবেশবিদ হতে হয়না। এলিতেলি গঙ্গু তেলিও এসব জানে। আপনি?
বর্ধমানের পুলিশ লাইন থেকে উল্লাস মোড় পর্যন্ত যে ছায়াসুনিবিড়, কুসুমাস্তীর্ণ রাস্তা ছিল সেখানে দুই ধারে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। হেব্বি। সুউচ্চ গগনভেদী আবাসন, হর্ম্য অট্টালিকা, ঝিংচ্যাক শপিং মলের সামনে আমি উন্নয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। স্পষ্ট দেখেছি। নিজের চোখে। কি তার ঝলমল লিবাস। চোখ ধাঁধানো বাহার ! কি তার বড়লোকির গরম !
উন্নয়ন হয়েছে তাই ওই রাস্তার দুধারে সুপ্রাচীন গাছগুলিও কাটা পড়েছে। পুরো সাফচাট। বহু বট, অশ্বত্থ, দেবদারু, শিরিষ, শিশু, সেগুন ছিল। আর নেই। ফিলহাল বর্ধমান ওই রাস্তা দিয়ে চাট, চা ও মদ খেতে যায়। বা কলকাতা যায়। উল্লাস মোড়ে সে কি উল্লাস। নামকরণের সার্থকতা। চিয়ার্স বেবি ! আই মিন ‘উল্লাস!’
বেশ কিছু পলাশ গাছও ছিল ওই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে। না না, শেরশাহ লাগাননি। উনি তখন ওই রাস্তায় অন্যান্য গাছের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে চিল করছিলেন হয়তো বা। হয়তো ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় এসে ওখানেই পড়েছিল পলাশের বীজ। এক বসন্তে বর্ষা নাম্নী এক প্রেমিকাকে ওই পলাশ গাছের তলার ফুল কুড়িয়ে খোঁপায় গুঁজে দিয়েছিলাম। বর্ষা এক প্রোমোটারকে বিয়ে করেছে। গাছগুলোকে উন্নয়নের কুঠার মেরেছে।আর এ রাজ্যে বর্ষা ক্ষণস্থায়ী হয়েছে। গ্রীষ্ম দীর্ঘতর, দহনময় হয়েছে। ওহ্ ইয়েস…বর্ধমানের ব্যাপক উন্নয়নও হয়েছে। এবং বর্ধমানের গরম বেড়েছে। বর্ধমানের গরম আসলে উন্নয়নের গরম।
গাছের সঙ্গে কুঠারের একটা সম্পর্ক আছে। কুঠারের সঙ্গে উন্নয়নের। উন্নয়নের সঙ্গে বুলডোজারের। জেসিবির। বা খর্গের। যারা নিন্দুক, যারা বিরোধী যারা হিংসুটে তারা উন্নয়ন দেখতে পায় না। হয়তো চোখে ন্যাবা। মনে কুচুটেপনা। নয়ন মেলে দেখলে ঠিক দেখতে পেতো বর্ধমানে দুর্দান্ত, মারকাটারি উন্নয়ন হয়েছে। টাকার-ক্ষমতার গরম থাকে আর উন্নয়নের গরম থাকবে না ! পাগল না সিপিয়েম ! দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন/রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।
শুধু বর্ধমানের গাছেই উন্নয়নের কোপ পড়েছে ? নহী জনাব। উন্নয়নের কুঠার বা খড়্গ যে কোনও প্রাচীন, বড় গাছকে, বৃক্ষ ও বনস্পতিকে টার্গেট করে। যেমন যশোর রোড। বারাসত থেকে পেট্রাপোল পর্যন্ত যশোর রোড সম্প্রসারণের জন্য ৪০৩৬টি গাছ কাটার পরিকল্পনা করেছিল রাজ্য পূর্ত দফতর। সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় এ.পি.ডি.আর। তখনকার মতো হাইকোর্ট গাছ কাটায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। গাছেরা ছিল উন্নয়নের পথে বাধা। বড় প্রতিবন্ধকতা। শেষমেষ যশোর রোডের বারাসত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত ৩০৫টি শতাব্দীপ্রাচীন গাছ কাটার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম আদালত জানিয়েছে, ৩০৬টি গাছ কাটার আগে ১৫০০টি গাছ লাগাতে হবে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে।
বর্ধমানের জি টি রোডের গাছগুলি কাটার সময়ও এমনই ডায়লগ শুনেছিলাম না আমরা ? প্রেস-ফ্রেস ডেকে কারা যেন ঘটা করে বলেছিল যা গাছ কাটা হলো তার ডাবল ট্রিপল গাছ লাগানো হবে ? কারা যেন? কী ! লাগানো হয়নি ? উন্নয়নের মসৃণ মাখনের মতো রাস্তায় খুব রোদ ? ধুলো ? তীব্র তাপপ্রবাহ ? গরম ?
মুখ সামলে কথা বলবেন। এসব বিরোধীদের অপপ্রচার। কেন্দ্রের চক্রান্ত। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ইয়ে। গুয়েতমালার ফ্যাসিবাদী ফাজলামো। ওই রাস্তায় লাখ লাখ না হোক, হাজার হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। করবী, বাগানবিলাস, কল্কে, পাতাবাহার। সে কি দুর্দান্ত বাহার ! উন্নয়নের সে কি নয়নাভিরাম পরিবেশ !যশোর রোড , জি টি রোডের বৃক্ষ নিধন বেশি মাইলেজ, বেশি ফুটেজ, বেশি টিআরপি পায়। গাঁয়ে, গঞ্জে, ক্যানেল, নদী নালার ধারে রাতারাতি গাছ কেটে সাফ করে দিচ্ছে উন্নয়নের পূজারীরা। বর্ধমানের গলসি, জামালপুর, রায়নায় প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটে। অনেকে বলে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এসবে আমরা কান দেবো না। চোখ দেবো না।
বিচ্ছিন্ন ঘটনায় আমল না দিয়ে আমরা বরং এসি চালিয়ে চিলড পরিবেশে ফেসবুকে গাছ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পোস্ট দেবো। জ্ঞান দেবো। ন্যাকা কান্না কাঁদবো। বা মরাকান্না।তীব্র দহন আর তাপপ্রবাহে না কি কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাপড়ির রঙ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কোথাও পড়লাম। আমার মেয়ের নাম কৃষ্ণচূড়া। আপনার সন্তানের নাম কী যেন?
ছবি – ফেসবুক