বাংলার মাটি, বাংলার বালি, বাংলার কয়লা, পাথর পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক

Souris  Dey

Souris Dey

ঋষিগোপাল মণ্ডল: …অ্যাক জন বড় মানুষ, তাঁরে প্রত্যহ নতুন নতুন মস্করামো দ্যাখাবার জন্য অ্যাক জন ভাঁড় চাকর রেখেছিলেন, সে প্রত্যহ নতুন নতুন ভাঁড়ামো করে বড় মানুষ মশায়ের মনোরঞ্জন কত্তো। কিছু দিন যায়, অ্যাক দিন সে আর নতুন ভাঁড়ামো খুঁজে পায় না, শেষে ঠাউরে ঠাউরে এক ঝাঁকা” নতুন খাবার নিয়ে বড় মানুষ বাবুর কাছে উপস্থিত। বড় মানুষ বাবু তাঁর ভাঁড়কে এক ঝাঁকা ইমারতি দ্রব্য ও হাবিজাবি আনতে দ্যেখে বল্লেন, ভাঁড়! এ কি হে?

বিজ্ঞাপন

ভাঁড় বল্লে ধর্ম্মাবতার “আজকের এই অ্যাক নতুন খাবারদাবার! অনেকেই না কি এ সব খেয়ে খেয়ে গায়ে গতরে হচ্চে। না খেতে পেয়ে মহল্লায় মহল্লায় চিল্লামিল্লিও হচ্চে বিস্তর। হুজুর, এই খাবার এম্নিতে বিল্কুল ফ্রি। মাগনায় মেলে বললেই চলে। তাঁর উপর পুরোপুরি ন্যাচারাল। প্রাকৃতিক। বোধহয় অর্গ্যানিকও। এই খাবারদাবারগুলো নিয়ে পার্টিতে, বাঙ্গলা মিডিয়াতে ও বাঙ্গালীর চায়ে পে হরদম চর্চা চলচে। আপনি আজ্ঞা দিলে নতুন বছরে উন্নততর ও নব্যবাঙ্গলার হিট ও হট এই খাবারের বর্ণনা কত্তে পারি।” হুজুরের আজ্ঞাক্রমে সেই ভাঁড় চাকর ঝাঁকা ভর্তি খাবারদাবারের যে বর্ণনা করেচিল তারই স্লাইট নকশানমুনা নিচে দিলুম 

মাটি :- পরমহংসের “টাকা মাটি মাটি টাকা” লব্জটির জুতসই ইস্তেমাল করে চাদ্দিকে অনেকেই মাল কামিয়ে নিচ্চে। জলাশয়, নদীর পাড়, দিঘীর পাড়, চাষের জমির মাটি খেয়ে খেয়ে হাপিস করে দিচ্চে মাটিমাফিয়ারা। ইঁট ভাটায়, মায়, ভিন রাজ্যে ট্রাক-ডাম্পার বোঝাই হয়ে দিনে রাতে পাচার হয়ে যাচ্চে এই খাবার। হুগলী, মালদা, পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম জেলায় এই খাবার বেশি খাওয়াদাওয়া হয় হুজুর। দো ফসলি, তিন ফসলি জমির মাটি কেটে ২০ ফুট ৩০ ফুট কেটে ইয়াব্বড় বড় গর্ত হচ্চে। বর্ষায় সেই গর্ত পুকুর হয়ে যাচ্চে। পুকুরের পাড় গজালে আবার মাটি আবার টাকা। এই ফর্মুলায় টাকা মাটি মাটি টাকা।

বালি:- সে গুড়ে বালি হোক বা না হোক, এ বালিতে গুড় মিছ্রি মধু ম’ ম’ করচে। খুবই মিষ্টি। ভেরি সুইট, হুজুর! তাই এই খাবার নিয়ে খাই-খাই লেগেই আচে। দামোদর, অজয়, দারকেশ্বর, ভাগীরথী, গঙ্গার বালি স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। আপনি হুজুর মাঈবাপ ; বাঙ্গলা যে নদীমাতৃক, তা তো আপনার বিলক্ষণ জানা আচে। নদীও প্রচুর, বালিও দেদার। বালিঘাটের ইজারা আর বখরা নিয়ে লাশ পড়চে। লাশ গায়েবও হচ্চে হয় তো ! এই খাবারের এমনই ডিমান্ড যে সরকার লাগাম কষেও ত্যামন সুবিধা করতে পার্চে না। সরকারী ই-চালান জাল করে, বিএলআরও আপিসের কর্তাদের উদ্মা ক্যালানি দিয়ে, আটকে রেখে, তাঁদের গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে সিন্ডিকেট আর মাফিয়ারা বালি খাচ্চে। এই খাবারের বখরা আর প্রসাদ-প্রণামী না কি উপর থেকে নিচে সাপ্লাইয়ের সুন্দর বন্দোবস্ত আচে। হাভাতের মতো বালি খাওয়ার কারণে নদীর ডায়রেকশন বেমালুম বদলে যাচ্চে, বান এলে নদীও সব ভাসিয়ে বদলা নিচ্চে। তবুও বালি খাওয়ার ট্রেন্ডে কোনরূপ বদল হচ্চে না। বেলাগাম বালি খাওয়াদাওয়া ও খেয়োখেয়ি রুখতে সরকার ‘স্যান্ড মাইনিং পলিসি-২০২১’ এনেচে। আগে বালি খননের কেস-কারবার ডিসট্রিক্ট কালেক্টর দেক্তো। নয়া পলিসি অনুসারে মিনারেল মাইনিং কমিটি দেকবে। দ্যাকা যাক!

পাথর:- শোনা কতা, পাশের মুলুকের বেহদ্দ বিচ্ছিনতাবাদীরা জম্মু কাশ্মীরের কচি কচি ছেলে ছোকরার মাথা খেয়ে হাতে পাথর আর ট্যাঁকে টাকা গুজে দিত। পাথর ছুঁড়লেই টাকা। এ দিকে সালানপুর, গড়বেতা, দেউচা-পাচামি আর আশপাশের বহু এলাকায় না কি পাথর ছুঁলেই টাকা। সার সার ক্রাশার দাঁড়িয়ে আচে পাথর খাদানে। লরি, ডাম্পার বোঝাই হয়ে পাথর দিনমানে, রাতবিরেতে এ দিক ও দিক যাচ্চে। এই খাবারের লাভের গুড় এতটাই বেশি যে লড়াই, খুনোখুনি আর রক্তারক্তি লেগেই আচে। লাভের লোভে ওয়্যার তো হবেই ধর্ম্মাবতার। এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ…

কয়লা:- এই খাবারটি দেখতে কালো কিন্তু খেতে ভালো । বচ্চন আর শত্রুঘ্ন অ্যাকবার এই খাবারটি নিয়ে ফিলিমও বানিয়েচিল । কালাপাত্থর । এর টানেই হয়তো সিনহাসাব আসানসোলে এলেন। জিতলেন। এর স্বাদের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে নানান কিসিমের ইন্তেজাম করা আছে । ‘প্যাড’ আচে । কুপন আচে । এগুলো দেক্তে এলেবেলে কিন্তু পাওয়ার পাসপোর্টের চেয়ে কম নয়। পাচারের সময় রাস্তাঘাটে দেকালেই চিচিং ফাঁক। অনেক হোয়াইট-কলার, সফেদ, সাফসুতরো উঁচু মাপের মানুষ এই কালোকুচ্ছিত খাবারটির বিজনেসে-বখ্রায় বেনামে যুক্ত আছে বলে শোনা যায়। এর রঙ কালো বলেই না কি ট্রাকে পাচারের সময়, ইল্লিগ্যাল খননের সময় পুলিশ প্রশাসনের নজর এড়িয়ে যায়। কেউই ত্যামন দেক্তে পান না। বা দেকেও দ্যাকেন না। সেই বর্ণবিদ্বেষ আর কি! তবে সামটাইম, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার করে বৈকি! খাদানে ধস নামলে , ধসের নিচে মানুষ মরলে, পাথর খাদানে লড়াই লাগ্লে নেতা মন্ত্রীরা মুক কালো করে টিভিতে বাইট-বক্তিমে দ্যান।

টীকা:- উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতরের লেখাগুলি হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে টোকা। হুবহু। যদ্দুর সম্ভব, হুতোম বর্ণিত বানানবিধি ফলো করা হয়েচে। কিছু ক্ষেত্রে কী-বোর্ড গড়িমসি করায় হুতোমি-বানান ষোলআনা আনা যায়নি। কী আর করা যাবে! পূজনীয় পাঠকগণ বেয়াদবী মাফ্ কর্ব্বেন।

ছবি – ইনটারনেট

আরো পড়ুন