festival

‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর’ মহালয়ার কাহিনী ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

ফোকাস প্রতিবেদন: সারা বছর অপেক্ষা শেষে আর মাত্র কয়েকটা দিন। আপামর বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গোৎসব আসন্ন। ত্রিনয়নী মা কে আবাহনের জন্য একদিকে যেমন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দিকে দিকে চলছে মণ্ডপ বাঁধার কাজ, শেষ মুহূর্তে প্রতিমায় তুলির টান, অন্যদিকে উৎসবের আনন্দে গা ভাসাতে নতুন পোশাক কেনার ভিড় উপচে পড়ছে শপিংমল থেকে সাবেকি বাজারগুলোতেও। এখন শুধু অপেক্ষা মহালয়ার। কারণ দুর্গা পুজোকে নিয়ে বাঙালির মূল আবেগ তৈরি হতে শুরু করে মহালয়ার দিন সকাল থেকে।

মহালয়া আসা মানেই বাঙালির মন আনন্দে আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মহালয়া মানেই পুজোর আর হাতে গোনা কটা দিন। মহালয়া মানেই দেবীপক্ষের সূচনা আর পিতৃপক্ষের অবসান। কিন্তু এই মহালয়ার সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে সনাতন ধর্মের কিছু সংস্কৃতি। মহালয়া কে নিয়ে দুধরনের মতের আভাস পাওয়া যায়। মহালয়া শুভ না অশুভ? একদিকে দেবী দুর্গার আবাহন মুহূর্ত মহালয়া, অন্যদিকে মহালয়ার সাথে জড়িয়ে আছে তর্পণ। মহালয়ার দিন দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হয়। শুরু হয় দেবীপক্ষের। তাই এই মত অনুযায়ী অনেকেই মনে করেন যে দিনটি অত্যন্ত শুভ।

আবার অনেকে মনে করেন যেহেতু মহালয়ার দিন প্রয়াত পিতৃ পুরুষদের জল দান করা হয়, তর্পণ করা হয় তাই এই দিনটি শোক প্রকাশের দিন, তাই এটি অশুভ। মহালয়া ঘিরে এই দুই ধরনের ধারণাই প্রচলিত রয়েছে। সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের
পূর্বপুরুষদের স্মরন করেন, আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষের শেষদিনও এটি। সাথে সাথেই শুরু হয় দেবী পক্ষ।

এই মহালয়া নিয়ে রামায়ণ, মহাভারত জুড়েও রয়েছে অনেক কাহিনী।

রামায়ণে বলা হয় মহালয়ার দিন স্বয়ং রামচন্দ্র তর্পণ করেছিলেন। রাবণ ছিলেন দেবী দুর্গার আশীর্বাদ ধন্য, সেই কারণে রাবনকে বধ করতে গেলে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ সবার আগে প্রয়োজন ছিল। তাই বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে শরৎকালে অনুষ্ঠিত করেছিলেন রামচন্দ্র, করেছিলেন দেবীর অকালবোধন। এই অকালবোধন করবার আগে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হতো, কারণ সনাতন ধর্মের রীতি যেকোন শুভ কাজের আগে তর্পণ করতে হয়। তাই রামচন্দ্র মহালয়ার দিন তর্পণ করেছিলেন।

আবার মহাভারতে তর্পণ সম্পর্কে লেখা আছে, মহাভারতের যুদ্ধে কর্ণ যখন নিহত হলেন তারপর তার আত্মা স্বর্গে গমন করল। কিন্তু স্বর্গে গিয়ে কর্ণ অবাক হয়ে দেখলেন অন্যান্য আত্মাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাকে খাবার হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দান করা হচ্ছে। এর কারণ তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে জানতে চাইলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর উত্তরে বলেন, কর্ণ সারাজীবন স্বর্ণরত্ন দান করে গেছে, কখনো পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে খাদ্য জল প্রদান করেননি। তাই দেহান্তের পর তার সাথেও এমনটা হচ্ছে। কর্ণ এরপর দেবরাজ কে জানান, এতে তার কোন দোষ নেই। কারণ কুমারী অবস্থায় কুন্তি তাকে জন্ম দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর রাধা আর অধিরথ তকে কুড়িয়ে পান এবং মানুষ করেন। তিনি তার নিজের জন্ম বৃত্তান্ত জানতে পেরেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে। তাই তিনি তর্পন করতে পারেন নি।

কর্ণের কোন দোষ নেই এই বিবেচনা করে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে পাঠিয়েছিলেন। আর এই সময় কর্ণ পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন। বলা হয় এই ষোল দিন সময় হলো পিতৃপক্ষ আর এই পিতৃপক্ষের শেষ দিন‌ই হলো মহালয়া। এইদিন থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষ। তাই মহালয়া নিয়ে শুভ ও অশুভ দুই ধরণের ধারণাই প্রচলিত। শুভ হিসেবে বিচার করেন কেউ, কেউ আবার ভাবেন অশুভ।

মহালয়া নিয়ে বাঙালির আবেগ ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র – 

মহালয়ার সাথে যে মানুষটি নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তিনি বাঙালির আবেগ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়া মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে দুর্গার আবাহন ধ্বনি, চণ্ডীপাঠ।১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে আকাশবাণী তে প্রথম বার প্রচারিত হয় বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী। পরে এটি মহালয়া তিথিতে পরিবর্তিত করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর গম্ভীর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ আজও শুধু মহালয়া নয় সারা পুজোর ইউএসপি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ শোনার সময়ে আমাদের সকলের উপলদ্ধি হয় একসময় তাঁর গলা ধরে আসে, ক্রন্দনরত হয়ে পড়েন তিনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলতেন এর কারণ হল তিনি সামনে তখন মা দুর্গাকে দেখতে পান।

আজ ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও সেই আবেগের ধারাই অব্যাহত রয়েছে। মাঝখানে ১৯৭৬ সালে একটি বছর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনীর জায়গায় ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তীর লেখা দেবী দুর্গতিহারিনীম অনুষ্ঠানের সম্প্রচার করা হয়েছিলো। এই অনুষ্ঠানের শ্লোক পাঠ করানো হয়েছিলো মহনায়ক উত্তম কুমারকে দিয়ে, কিন্তু অনুষ্ঠান চলাকালীন শ্রোতারা ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দিতে শুরু করেন, অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই আকাশবানী ভবনের সামনে বিশাল জনতা হাজির হয়ে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।

প্রবল জনরোষের মুখে পড়ে কলকাতা আকাশবাণী কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন তাদের ভুল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র শুধু একটি কন্ঠ নয়, এটি বাঙালির নস্টালজিয়া, আবেগ। তাই সেই বছরই দুর্গা ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া সম্প্রচারিত করা হয় আকাশবাণী কলকাতায়। আর আজ? এতগুলো বছর পেরিয়েও যেখানে টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে এত মহালয়ার মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান হয়, তবুও মানুষ আজ‌ও এই দিনটায় ভোরবেলায় উঠে ঘরের কোন তাকে তুলে রাখা রেডিও নামিয়ে ঝেড়ে পুঁছে তাতে ব্যাটারি লাগিয়ে নেয়। শুধুমাত্র বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার জন্য। মহালয়ার দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর”শুনেই বাঙালির পুজো শুরু হয় আজও।

এইবছর মহালয়া কবে পড়েছে ও অমৃতযোগ ২০২২ সালে মহালয়া হল ৮ ই আশ্বিন অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর, রবিবার। ২০২২সালে মহালয়ায় অমাবস্যার তিথি হল- ৭ই আশ্বিন,২৪শে‌ সেপ্টেম্বর, শনিবার রাত ২টো ৫৫ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড থেকে শুরু করে, ৮ই আশ্বিন অর্থাৎ ২৫শে সেপ্টেম্বর রবিবার রাত ৩ টে ২৪ মিনিট ১৭ সেকেন্ড পর্যন্ত থাকছে। ২০২২ এর মহালয়ায় অমৃতযোগ শুরু দিবা ঘ ৬।২৩ গতে ৮।৪১ মধ্যে ও ১১।৪৫ গতে ২।৫০ মধ্যে এবং রাত্রি ঘ ৭।৩৮ গতে ৯।১৮ মধ্যে এবং ১১।৫৭ গতে ১।২৭ মধ্যে ও ২।১৭ গতে ৫।৩০ মধ্যে।