সংস্কৃতি

এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর – সাহিত্য সম্রাটের শুভ জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্ধমান: ” ওসমান, যদি তুমি জিজ্ঞাসা কর, তা‍হলে আমার উত্তর এই যে, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর “( দুর্গেশনন্দিনী, পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ )। শুরুতেই আয়েষার সংলাপের শরণ নিতে হল এই কারণে যে সত্যই তিনি আমার হৃদয় কারাগারে বন্দী এক প্রাণেশ্বর। সেই কোনকালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় হাতে এসেছিল রাজসিংহ উপন্যাসের একখানি অতীব সস্তা কাগজে ছাপা সংস্করণ। তখন থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র আমার হৃদয়ে বন্দী। রাজসিংহ উপন্যাসের অমিত সম্পদশালী ভাষা বোঝার বয়স সেটা নয়। কিন্ত মনে ঝড় তুলে দিল জেবউন্নিসার বিলাসকক্ষটির বর্ণনা। ” ইহা কুবের ও কন্দর্পের রাজ্য। চন্দ্র সূর্য্য তথায় প্রবেশ করে না। যম গোপনে ভিন্ন তথায় যান না। বায়ুরও গতিরোধ। তথায় গৃহসকল বিচিত্র ; গৃহসজ্জা বিচিত্র ; অন্তঃপুরবাসিনী সকল বিচিত্র। এমন রত্নখচিত ধবলপ্রস্তর নির্ম্মিত কক্ষরাজি কোথাও নেই। …..এত ভোগবিলাস জগতে আর কোথাও নেই। এত মহাপাপ আর কোথাও নেই।

সেই শুরু। তারপর যতভাবে যতদিক থেকে সাহিত্যসম্রাট সত্যদ্রষ্টা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রকে চেনার চেষ্টা করেছি তাতে ফল হয়েছে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো। বিপুল ঐ জলরাশির তল আজও মেলেনি। আসলে বঙ্কিমচন্দ্রকে পড়তে হয়। পড়েই যেতে হয়। সে পাঠের স্থায়ীত্ব আজীবন। ১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী যখন প্রকাশ হল তখন তিনি এই ৩০৭ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ উপন্যাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধায়। দশ বছর আগে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ললিতা পুরাকালিক গল্প তথা মানস – এর পাঠকদাক্ষিণ্য বঞ্চনার পরিণতি তিনি বিস্মৃত হন নি। গ্রন্থটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয় নি।

ভাই পূর্ণচন্দ্র লিখছেন , দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশিত হওয়ার আগে তিনি সেটি কাঁটালপাড়ার বাটিতে অনেককে পড়ে শুনিয়েছিলেন। এই কাজটি কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের স্বভাববিরুদ্ধ। ফলে দুর্গেশনন্দিনী কে ঘিরে লেখকের টেনশন টা বোঝা যায়। কিন্তু প্রকাশের পর পাঠকমহলে যে আলোড়ন তৈরী হল তার নেপথ্য ঐ অতি সমৃদ্ধিশালী সমাসঝংকৃত ভাষা। বঙ্কিম চেতনার স্তরগুলি বহুমাত্রিক। সাহিত্যিক বঙ্কিম, ধর্মবেত্তা বঙ্কিম, সমাজ সংস্কারক বঙ্কিম। স্বল্প জীবনকালে যা ছুঁয়েছেন তাই সোনা হয়েছে।

আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সুযুক্তির ও অন্তর্দৃষ্টির আবাহনকারীদের অন্যতম। …বঙ্কিমচন্দ্র অধ্যয়ন আলোচনা ও অনুশীলনের কঠিন পথ অবলম্বন করিয়া কর্তব্য নির্ধারণের পক্ষপাতী।” বস্তুত এটা অনস্বীকার্য যে একধরণের প্রশ্নদীর্ণ আত্মঅন্বেষণ বঙ্কিমচন্দ্রের সারা জীবনের সাহিত্য ও দর্শন সাধনার ভরকেন্দ্র। এ জীবন লইয়া কি করিব? এই প্রশ্ন বারবার নিজেকে করেছেন। তারপর উত্তর খোঁজ করেছেন সেক্সপিয়ারের নাটক থেকে বেন্থাম বা মিলের দর্শনতত্ত্বের অঙ্গনে। স্বাঙ্গীভূত এত অনন্ত অস্তিত্বকে যেন চিরকাল ছুঁতে চেয়েছেন। অবলোকন করতে চেয়েছেন চিরপ্রবহমান মানবজীবনের অমোঘ প্রস্থানবিন্দুটিকে।

মাত্র সাড়ে এগার বছর বয়সে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর হুগলি কলেজের বিদ্যালয় বিভাগে পদার্পণ করেন বঙ্কিমচন্দ্র। ছাত্রাবস্থায় ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে কবিতা ও কটি গদ্য ছাপা হয় তাঁর। গুপ্তকবির সঙ্গে দেখা হওয়ার ক্ষণটিও দেখি বঙ্কিমচন্দ্রের মানসপটে উজ্জ্বল। অর্থাৎ বঙ্কিম মানসের কর্ষণ ক্ষেত্রটি যেন বঙ্গ সরস্বতীর আপন তত্ত্বাবধানে তৈরী হচ্ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনদর্শনের বস্তুগত তাৎপর্য টি ঠিক কি ছিল তা জানতে হলে সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করা যাবে না। সেসময় একদিকে বিজ্ঞানের কল্যাণে ইওরোপে যন্ত্রসভ্যতার বিপুল উত্থান ও পুঁজিবাদের প্রসার। ঠিক তারই বিপ্রতীপে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস প্রবর্তিত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের চিন্তাচর্চা। আর এই দুইয়ের মাঝে মিল বেন্থাম কোঁৎ হাবার্ট স্পেন্সারের radical ও rational humanist চিন্তাধারার করাঘাত এদেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনোজগতে আলোড়ন তুলেছিল।

বঙ্কিমচন্দ্রের ওপর এই তৃতীয় ধারাটির প্রভাবই ছিল সর্বাধিক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব তাঁকে প্রভাবিত করছে। এই ক্রান্তিকালে তিনি বেছে নিয়েছেন বহুজন সুখায় বহুজন হিতায়ের পথটি। সাহিত্য বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে নিতান্তই বিনোদনের বস্তু নয়। তা সমাজগঠনেরও অঙ্গ। বঙ্গদর্শনে তিনি যখন লিখছেন বঙ্গদেশের কৃষক নিবন্ধ। তখনও দেখছি রায়ত ও জমিদার উভয়ের সন্তুষ্টিবিধানে একধরণের optimisation এর চিন্তাধারাই আছে তাঁর মননে। বিবিধ প্রবন্ধের দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত এই নিবন্ধে তিনি একদিকে যেমন হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত্তের দুর্দশার কথা তুলে ধরছেন, তেমনই বলছেন, আমরা জমীদারদিগের দ্বেষক নহি। কোনও জমিদার কর্ত্তৃক কখন আমাদিগের অনিষ্ট হয় নাই। বরং অনেক জমীদারকে আমরা বিশেষ প্রশংসাভাজন মনে করি। অর্থাৎ এখানে একধরণের শ্রেণী সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

জীবনের চল্লিশ বসন্ত পেরিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র খাঁটি হিন্দু হয়ে ওঠার সাধনায় ব্রতী হলেন। প্রবলভাবে হিন্দু শাস্ত্রের অধ্যয়নে রত হলেন তিনি। ১৮৮৬ তে প্রকাশিত হল কৃষ্ণচরিত্র প্রথম ভাগ। তখন লেখকের বয়স আটচল্লিশ। পঁয়তাল্লিশের পর অনেক বদলে গেছেন বঙ্কিম। মিলের প্রভাব তখন তাঁর জীবনে ক্ষীণ। অনতি অতীতে ১৮৮৪ তে প্রকাশিত হয়েছে আনন্দমঠ। এক নতুন বোধ এসেছে জীবনে। কমলাকান্ত এবার নিয়োজিত হয়েছেন হিন্দুধর্মের সারার্থ উদ্ধারে। ধর্মতত্ত্ব প্রথম ভাগের প্রকাশ ১৮৮৮ তে। সবগুলোই প্রথম প্রকাশকালের হিসেব। একসময় বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে সমাজকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র।

মানুষের মনের গহীন বিসর্পিল সেই চলন অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ দেখাবেন চোখের বালি উপন্যাসে। সে পথের ভগীরথ অবশ্যই বঙ্কিম। একটা কথা কিছু সমালোচক অবশ্য বলে থাকেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা খানিক দুর্বোধ্য। সাধারণ পাঠকের পক্ষে কিছুটা চাপের ; এর উত্তরে একটা কথাই বলা চলে যে সমকালে তাহলে তাঁর উপন্যাসসমূহ এত জনপ্রিয় হতো না। সর্বোপরি পাঠও নিশ্চিত একটা academic কাজ। এবং ধীমান পাঠকেরও দায় আছে নিজেকে দীক্ষিত পাঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – দার্জিলিং হইতে যাঁহারা কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরমালা দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন, সেই অভ্রভেদী শৈলসম্রাটের উদয়রবিরশ্মিসমুজ্জ্বল তুষার কিরীট চতুর্দিকের নিস্তব্ধ গিরিপারিষদবর্গের কত ঊর্ধ্বে সমুত্থিত হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য সেইরূপ আকস্মিক অত্যুন্নতি লাভ করিয়াছে। একবার সেইটি নিরীক্ষণ এবং পরিমাণ করিয়া দেখিলেই বঙ্কিমের প্রতিভার প্রভূত বল সহজে অনুমান করা যাইবে।

বি: দ্র:- লেখাটির জন্য শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গোপাল হালদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিমানবিহারী মজুমদার, বিজিতকুমার দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, সুকুমার সেন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, রামবহাল তেওয়ারি, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য প্রমুখ দিকপালদের রচনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

Recent Posts