বর্ধমানে দুই বন্ধুর মানবিক কীর্তি, নীরবে প্রতিদিন ৪০০ মানুষকে খাইয়ে চলছেন

Souris  Dey

Souris Dey

ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান: মানুষের সেবা করার মানসিকতা থাকলে ইচ্ছাটাই সবথেকে বড় মূলধন। আর তার সাথে যদি পাওয়া যায় সহৃদয় কিছু মানুষের সহযোগিতা, তাহলে রাস্তা আরো মসৃন হয়ে যায়। কোনো সংগঠিত শক্তি নয়, নয় কোনো সরকারী ব্যবস্থাও – কেবলমাত্র নিজেদের অন্তরের তাগিদেই বর্ধমান শহরের দুই ব্যবসায়ী বন্ধু নীরবে বর্ধমান শহরের অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন প্রতিদিন সন্ধ্যায়। কার্যত প্রচারের আড়ালে থেকেই। উল্লেখযোগ্য ভাবে এই কাজ তাঁরা গত বছর লকডাউন শুরুর পর থেকেই শুরু করে আজও সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে লকডাউন কয়েকমাস উঠে যাওয়ায়, সপ্তাহে দুদিন এই কাজ তাঁরা যথারীতি চালিয়ে গেছেন।

বিজ্ঞাপন

বর্ধমান শহরের সর্বমঙ্গলা পাড়ার বাসিন্দা রাজীব রায় এবং আঁজিরবাগান এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় সাউ উভয়েই রাইস ব্রানের ব্যবসায়ী। গতবছর ২২ মার্চ লকডাউন ঘোষণার কয়েকদিন পর থেকেই তাঁরা শুরু করেন এই মানবিক কাজ। সঞ্জয় সাউ জানিয়েছেন, লকডাউন ঘোষণার কয়েকদিন পর তাঁদের নজরে আসে বর্ধমানের মুখ্য ডাকঘরের সামনে দুজন ভিখারী কার্যত না খেতে পেয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। লকডাউনের জেরে কোথাও ভিক্ষের জন্য যাবারও উপায় ছিল না তাদের। বন্ধ ছিল সমস্ত দোকানপাট। রাস্তায় লোক ছিল না। এই অবস্থায় কয়েকদিন খেতে না পেয়ে তাঁরা মৃত্যুমুখে পড়েছিলেন। এই দৃশ্য তাঁদের নাড়া দেয়। এরপরই তাঁরা নিজেদের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে প্রতিদিন দিতে থাকেন ওই দুই ভিখারীকে। আস্তে আস্তে এই সংখ্যাটা বাড়তে থাকে।  

সঞ্জয়বাবুরা জানিয়েছেন, গতবছর লকডাউনের সময় প্রতিদিন প্রায় ২০০ মানুষকে তাঁরা সন্ধ্যায় খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। বিশেষ করে বর্ধমান পুরসভার সামনে জিটি রোডের পাশে থাকা অসহায় মানুষদের খাবার তুলে দিতে থাকেন তাঁরা। অবশ্য মাঝখানে লকডাউন শিথিল হলে তাঁরা সপ্তাহে ২দিন করে খাবার দিতে থাকেন। কিন্তু পরে আবার লকডাউন শুরু হয়। ফলে তাঁদের প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। সঞ্জয়বাবুরা জানিয়েছেন, প্রথম দিকে বাড়ি থেকে খাবার তৈর করে নিয়ে এসে দিতেন। কিন্তু এভাবে বেশিদিন সম্ভব হয়নি। ফলে তাঁরা ডেকরেটর থেকে বাসনপত্র ভাড়া নিয়ে রান্না করে খাবার দিতে থাকেন। কিন্তু ডেকরেটরের প্রতিদিনের ভাড়া ছিল ৮০০ টাকা। ফলে তাঁরা চিন্তায় পড়েন। এই অবস্থায় তাঁরা দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা নিজেরাই রান্নার সমস্ত সরঞ্জাম কিনে নেবেন। সেই মোতাবেক প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে কিনে ফেলেন বাসনপত্র। শহরের বাদামতলা এলাকায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে প্রতিদিন ৩জন রাঁধুনিকে দিয়ে শুরু হল রান্নার কাজ। 

রাজীববাবুরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাঁরা সেই খাবার ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে সরবরাহ করতে শুরু করলেন। এখন সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০তে। প্রতিদিন এই খাবারে থাকছে খিচুরি, চাটনি। কোনো কোনোদিন চিকেন দিয়ে খিচুরি, কোনোদিন খিচুরির সঙ্গে একটি সব্জী, ডিমভাজা।

আর এভাবেই ওইসব মানুষগুলোর একঘেয়েমি কাটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা। এই দুই বন্ধুই জানিয়েছেন, তাঁরা লক্ষ্য করেছেন, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে খাবার দেওয়া হলেও তাঁদের এই খাবার নেবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন ফুটপাতবাসীরা। আর তাঁদের এভাবে খাওয়াতে পেরে তাঁরা নিজেরাও সন্তুষ্ট, আপ্লুত। 

তাঁরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে লকডাউন উঠে গেলেও তাঁরা এই ভবঘুরে, ফুটপাতবাসীদের সপ্তাহে এক থেকে দুদিন এভাবেই খাবার খাইয়ে যাবেন। উল্লেখ্য, এভাবে খাবার দিতে রাজীব সঞ্জয়দের প্রতিদিন গড়ে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। তাঁরা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে তাঁদের কয়েকজন বন্ধুও সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁরা আরও উৎসাহ পাচ্ছেন আরো বেশি এই ধরণের অসহায় মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে।

আরো পড়ুন