ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,বর্ধমান: বাড়ি ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে গেলেও ঘুণাক্ষরেও তার টের পায়নি এলকাবাসী। ২০১৪ সালের ২অক্টোবর তার খেসারত দিতে হয়েছে বর্ধমানের খাগড়াগড় এলাকার বাসিন্দাদের। ভয়াবহ আইইডি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল এলাকা। ভাড়া বাড়ির দোতলা ঘরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল এক জঙ্গির দেহ। বিস্ফোরণে গুরুতর জখম হয়েছিল আরেক জঙ্গি। রক্তে ভেসে গিয়েছিল দোতলার ভাড়া ঘর। সেই ঘটনায় গোটা দেশ জুড়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
ভুল তথ্য দিয়ে ঘিঞ্জি এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং তারই জেরে ভয়ংকর পরিণতির পরেও কার্যত টনক নড়েনি খাগড়াগড় ও তার আশপাশের এলাকার বাড়িওয়ালাদের। তার প্রমাণ ফের পূর্ব মাঠপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাড়ি থেকে জাল নোট তৈরির কারখানার হদিস পুলিশ খুঁজে পাওয়া। ইতিমধ্যেই জাল নোট কাণ্ডে বর্ধমান থানার পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ধৃতদের হেফাজতে নিয়ে এই চক্রে আরো কারা জড়িত আছে তাদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রেও দুষ্কৃতীরা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল বাড়িওয়ালা কে সম্পূর্ন ভুল তথ্য দিয়েই। প্রতিবেশীরাও এক্ষেত্রে টের পাননি তাঁদের পাশেই গোপনে চলছে দেশবিরোধী কার্যকলাপ।
আর এই ঘটনার পরই বর্ধমান জেলা পুলিশ তৎপর হয়েছে খাগড়াগড়, কেষ্টপুর, সরাইটিকর, মাঠপাড়া সহ আশপাশের এলাকার প্রত্যেক ভাড়াটেদের তথ্য সংগ্রহ করতে। ইতিমধ্যেই পুলিশ এই সমস্ত এলাকায় মাইকিং করে প্রচার অভিযান চালিয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সাতদিনের মধ্যে প্রত্যেক বাড়ি মালিককে তার বাড়িতে বসবাসকারী ভাড়াটিয়া ও তাদের সঙ্গে যারা থাকেন তাদের বিশদ তথ্য বর্ধমান থানায় জমা করতে হবে। এব্যাপারে একটি ফর্ম ফিলাপ করে ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা, কি করেন, কি কারণে ভাড়ায় বাড়ি নেওয়া হয়েছে, ফোন নম্বর ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য লিখে বাড়ি মালিক কে এই ফর্ম বর্ধমান থানায় জমা করার কথা বলা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কল্যাণ সিনহা রায় বলেন,” ভাড়াটেদের তথ্য প্রত্যেক বাড়ি মালিককে দিতেই হবে। এব্যাপারে আমরা আর কোনো গাফিলতি বরদাস্ত করবো না। ভাড়াটেদের তথ্য সম্বলিত ফর্ম জমা পরার পর সেইসব ফর্ম খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হবে। বিশেষ করে বর্ধমান থানা এলাকার বাইরে থেকে যারা বর্ধমান শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন এবং থাকছেন তাদের সম্পর্কে বিশদ জানতে সেই ভাড়াটে যে থানার বাসিন্দা সেখানেও খোঁজখবর নেওয়া হবে। সন্দেহজনক কোনো বিষয় থাকলে সেই ভাড়াটে কে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হতে পারে। তবে এক্ষনি কোনো আইনি পদক্ষেপ আমরা নিতে চাইছি না। খুব শীঘ্রই এলাকার সাধারণ মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় জন প্রতিনিধি দের নিয়ে আলোচনা করে এব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জেলা পুলিশ এই এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই এগোচ্ছে ”
বর্ধমান থানা সূত্রে জানা গেছে গত ২৩তারিখ থেকে খাগড়াগড় সহ সংলগ্ন এলাকায় টোটো করে প্রচার চালানো হয়েছে। এলাকার বাড়ি মালিকদের উদ্দেশ্যে ভাড়াটে দের তথ্য থানায় জমা করার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। চারদিন পেরিয়ে গেছে। মাত্র ৬টি ফর্ম জমা পড়েছে থানায়। স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিস ও বর্ধমান পৌরসভায় কিছু ফর্ম পাঠানো হয়েছে, যাতে মানুষ সেখান থেকেও সংগ্রহ করে নিতে পারেন। আরো কয়েকদিন সময় আছে। আর তারপর সব দিক খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে পুলিশ। শুক্রবার থানায় যে কটি ফর্ম জমা পড়েছে সেইগুলি পরীক্ষা করে দেখেন আই সি সুখময় চক্রবর্তী। বেশ কিছু নির্দেশও দেন অফিসারদের।
বর্ধমান জেলা পরিষদ সদস্য তথা বর্ধমান ১ব্লকের তৃণমূল নেতা নুরুল হাসান বলেন, ” এলাকার নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রশাসনের জারি করা নির্দেশ সকলের মানা উচিত। কেউ না মানলে সেটা সরকারি নির্দেশ অমান্যের সমান। এরপর পুলিশ আইনত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্থানীয় বাড়ি মালিকরাই সমস্যায় পড়বেন।” স্থানীয় খাগড়াগড় যুব সংঘ ক্লাবের সদস্য শেখ ইমতিয়াজ বলেন,” প্রায় আড়াইশ থেকে তিনশ বাড়ি রয়েছে এই এলাকায়। এলাকার ৮০শতাংশ বাড়ি মালিক এখনও ভাড়াটে দের তথ্য জমা করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি। ২০শতাংশ বাড়ি মালিক এই ফর্ম থানায় জমা করেছে বলে শুনেছি। বরং ভাড়াটেদের নিয়ে একের পর এক ঝামেলার জন্য এলাকার অনেক বাড়ি মালিক ভাড়াটেদের বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য বলে দিয়েছেন। পরবর্তী পরিস্থিতিতে কি হবে দেখে তবেই আবার তারা বাড়ি ভাড়া দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।”
যদিও স্থানীয় সরাইটিকর গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য শেখ ফিরোজ বলেন,” ভাড়াটে দের তুলে দেওয়ার তথ্য একদম ভুল। মোটা টাকার বিনিময়ে বাড়ি ভাড়ার চুক্তি করে ভাড়া উঠিয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগই এই এলাকার বাড়ি মালিক দের নেই। ওতো বড় বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও যারা ভাড়াটেদের কোনো তথ্য যাচাই না করেই বছরের পর বছর ভাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, তারা জাল নোট কান্ডের পর নিজের রোজগার বন্ধ করে ভাড়া তুলে দেবে – তা কেউই করবে না। আবার পুলিশ ও প্রশাসন এতবার করে নির্দেশ দিলেও এলাকার বাড়ি মালিকদের সেভাবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ভাড়াটেদের তথ্য জানানোর। তবে প্রশাসন আমাকে যদি কোনো নির্দেশ দেয় আমাকে সেটা পালন করতে হবে।”
খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কান্ডের সেই অভিশপ্ত বাড়ির সামনেই বাড়ি শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদের। তিনি বলেন, ” আমার বাড়িতেও ভাড়াটে আছেন। পুলিশের নির্দেশ অনুযায়ী আমি ফর্ম সংগ্রহ করেছি। আগামীকাল বর্ধমান থানায় সমস্ত তথ্য জানিয়ে জমা করবো। এই এলাকার প্রত্যেক বাড়ি মালিকের উচিত প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করা। কারণ কিছু লোকের ভুলে যখন কোনো বড়সড় অঘটন ঘটে যাচ্ছে তখন এই এলাকারই যেমন বদনাম হচ্ছে, মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে তখন মানুষকে সুরক্ষা দিতে সেই পুলিশকেই কাজ করতে হচ্ছে। তাহলে কেনো বিপদ ঘটার আগে মানুষ সতর্কতা নেবেন না? অবিলম্বে ভাড়াটিয়াদের তথ্য প্রত্যেক বাড়ি মালিকের থানায় জমা করা উচিত।”