সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: পায়ের তলায় সর্ষে কথাটা বাঙালির সম্পর্কে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে । ভ্রমণপিপাসু বাঙালি ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর সর্বত্র। পকেটের পয়সা খরচ করে বিশ্বভ্রমণ করতে বাঙালির জুড়ি নেই। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের সিনিয়ার প্রফেসর অধ্যাপক ড. গোপা সামন্ত ঠিক এই থাকের মানুষ বলা যাবে না। তিনি বিশ্বভ্রমণ করেছেন মূলত বিদ্যায়তনিক কাজের সূত্রে। কিন্তু প্রকৃতি ও মানুষ এই দুইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা তাঁকে দিয়েছে এমন এক প্রখর পর্যবেক্ষণ শক্তি যা তাঁর দর্শনকে সেমিনার কক্ষের চার দেওয়ালের গণ্ডী ভেঙে দাঁড় করিয়েছে অসীম আকাশের নীল গালিচার নিচে। সেখানে এসে তাঁর চারপাশে ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য চরিত্র।
ড.সামন্ত বিদেশ গেছেন গবেষণার কাজে। কিন্তু গবেষণার বাইরেও জড়িয়ে গেছেন আরও এক বৃহত্তর অনুসন্ধানে। যার উপজীব্য প্রকৃতি ও মানুষ। বার্ণিক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ” রাইন থেকে গঙ্গা ” সেই মনোজ্ঞ অভিজ্ঞতার বিবরণ। নদীর সঙ্গে মানবসভ্যতার নিবিড় সম্পর্ক গোপা দেবীর বিশেষ আগ্রহের বিষয়। ফলে এ বইয়ের পাঠক টেমস – রাইনের তীরে যখন হাঁটবেন তখন কখন যেন গল্পের ছলে জানা হয়ে যাবে নেদারল্যাণ্ডসের ভৌগোলিক ইতিকথা। জেনে অবাক হতে হবে যে পাঁচ লক্ষ বছর আগে এদেশ থেকে ইংল্যাণ্ডে পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যেত। রাইন নদীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব লেখক অনুধাবন করেছেন। তাতে আগ্রহ বোধ করেছেন এবং এক সকালে লাইডেন শহর থেকে সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন রাইন দর্শন করতে।
গোপা সামন্তের পূর্বের ভ্রমণ সংক্রান্ত বই পথের ডায়েরি বা প্যারিসের কলাম যারা পড়েছেন তারা জানেন, তিনি যখন তাঁর পাঠকদের বিদেশের গল্প শোনান তখন ভূগোলের নামী অধ্যাপকের মোটা চশমাখানি দূরে সরিয়ে রেখে হাতে তুলে নেন স্বাদু গদ্যের ভিয়েনে জারিত একখানি সরস কলম। তা থেকে বেরিয়ে আসে কখনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কখনও কৌতুক আবার কখনও প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্কের জীবনতত্ত্ব। ঐতিহাসিক নেদারল্যাণ্ডসের ভূপ্রকৃতির স্বচ্ছন্দ বিবরণ তাই এই বইয়ের পাতায় পাতায়। সঙ্গে বাড়তি পাওনা অচেনা মানুষদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ। লেখকের কলমে উঠে আসা ভ্যালেরি বা সিলভি কখন যেন হয়ে উঠেছেন আমাদের খুব চেনাজানা মানুষ।মিউজিয়াম প্রধান মারিয়ানের যে সৌজন্যের কথা জানলাম তা বোধহয় ইওরোপেই সম্ভব। ইউরোর যে হিসেব বর্তমানে তাতে কোনও বঙ্গসন্তান ওই দেশ ঘুরতে গেলে পকেটে ভাল রেস্ত থাকা একান্ত দরকার। ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়া হল্যাণ্ডের উইণ্ডমিলের কথা পড়ে যেন মানসচক্ষে দেখা গেল সবটা।
হল্যাণ্ড পর্বের পর ভিয়েতনাম পর্ব। হো চি মিনের দেশে বঙ্গকন্যার সফর বেশ আলাদা স্বাদের গদ্যে উদ্ভাসিত বটে। পড়তে পড়তে বোঝা যায় বিদেশ তার ঐতিহ্যকে হেরিটেজ কে কতই না সম্মান করে। ইতিহাসকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের ইতিহাস বাঁচানোর তাগিদ নেই। বরং এখন মেতেছি ইতিহাস বদলানোর খেলায় ।
বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যারিস লেখকের অতি প্রিয় স্থান। বারবার তিনি ছুটে আসেন এখানে। এবারে তিনি সীন নদীকে হাড়েমজ্জায় খতিয়ে দেখার চেষ্টায় ব্যাপৃত। সেই এক্সপ্লোরার যে কখন প্যারিস থেকে আপনাকে হাজারিবাগে এনে ফেলবেন তার আগাম আঁচ মেলা দুষ্কর। দোলের সময় হাজারিবাগের রাস্তায় মাতালের যা উপদ্রব তাতে বইয়ের নাম হ্যানয় থেকে হাজারিবাগ হলেও বোধহয় মন্দ ঠেকত না। মংপুও ছুঁয়ে আসা হল এক ফাঁকে।
দ্বিভাষিক বইয়ের ইংরাজীতে লেখা অংশটিতে এক জায়গাতে লেখক জানিয়েছেন, সিলভি বর্ধমান শহরে এসেছিলেন ২০১৪ সালের মে মাসে। জানতে ইচ্ছা করে – চাঁদিফাটা রোদে রানিগঞ্জ বাজার চৌমাথার জ্যামে কখনো পড়েছিলেন কি? অমিতাভ ঘোষ মহাশয়ের প্রখ্যাত উপন্যাস THE HUNGRY TIDE যে মহাশয়াকে সুন্দরবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা জেনে ভাল লাগল। উল্লেখ রয়েছে, ঐতিহাসিক মরিচঝাঁপির । সুন্দরবনে ভ্রমণের ইতিবৃত্তটুকু পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল মানুষের লোভ ও লালসার শিকার হয়ে দুই বাংলার গর্ব এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল আর কতদিন নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে কে জানে। বইটির বিরাট সম্পদ এর অমূল্য ছবিগুলো। সুমুদ্রিত হার্ডকভার বইটি খুবই যত্নে নির্মাণ করেছেন বার্ণিক প্রকাশন। প্রচ্ছদ নির্মাণে অর্পণ। বিনিময় মূল্য ২৫০ টাকা মাত্র।