সৌরীশ দে,বর্ধমান: ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে গোটা দেশ জুড়ে পালন করা হচ্ছে আজাদী কা অমৃত মহোৎসব। আর তারই অঙ্গ হিসেবে জাতীয়তাবোধ কে আরও জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে দেশবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে জাতীয় পতাকা। যে কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘হর ঘর তিরঙ্গা’। ইতিমধ্যেই ডাক বিভাগের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়েছে কয়েক কোটি জাতীয় পতাকা। পাশাপাশি ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে মন্ডল সভাপতিদের মাধ্যমে এলাকায় এলাকায় বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হচ্ছে এই জাতীয় পতাকা। এই পতাকার মাপ সবগুলোর ক্ষেত্রেই সমান। কিন্তু এই কর্মসূচি কে ঘিরেই জোর বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে বর্ধমান শহরে। বর্ধমানের শহরের ৩নং মণ্ডলের পারবিরহাটা এলাকায় বিজেপির পক্ষ থেকে বিতরণ করা বেশ কিছু পতাকায় দেখা গেছে ত্রুটি।
এমনকি রীতিমত অভিযোগ উঠেছে জাতীয় পতাকার অবমাননার। অভিযোগ উঠেছে, বিজেপির পক্ষ থেকে যে সমস্ত জাতীয় পতাকা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে তার অধিকাংশই বিকৃত। জাতীয় পতাকার গেরুয়া, সাদা ও সবুজ অংশের কাপড়ের মাপ অনেক পতাকারই ঠিক নেই। কোনটার ছোট, তো কোনটার বড়। আবার জাতীয় পতাকার এক্কেবারে মাঝে যে চক্র থাকার নিয়ম, এক্ষেত্রে অনেক পতাকায় সেটি সরে গেছে ডানদিকে কিংবা বামদিকে। এমনকি অনেক পতাকার বিভিন্ন অংশ ছেঁড়া অবস্থায় সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আরও অভিযোগ, এই সমস্ত জাতীয় পতাকা যত্রতত্র লাগিয়েও দিচ্ছেন সাধারণ মানুষেরা। ফলে দেশের জাতীয় পতাকার ব্যবহার ও সম্মান নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আগেই অবমাননার অভিযোগ কে ঘিরে সোচ্চার সাধারণ মানুষ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
বর্ধমান আদালতের আইনজীবী তথা সিপিআই নেতা রামেন্দ্রসুন্দর মন্ডল বলেন, “কারা, কি উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকা হটাৎ বিতরণ করছে সেটা দেখতে হবে। জাতীয় পতাকার বিকৃতি কোনো ছোটখাটো অপরাধ নয়, এটা সাংবিধানিক অপরাধের বিষয়। দেশদ্রোহিতার ধারায় এদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। এরা নিজেরাই কোনোদিন ন্যাশনালিস্ট হয়ে উঠতে পারিনি। এরা আসলে নিহিলিশ্ট অর্থাৎ সকল ধর্ম ও নীতি বর্জনকারী, নিরীশ্বরবাদী, অনস্তিত্ববাদী। বরং এরাই এখন ফ্যাসিস্ট হওয়ার লক্ষ্যে রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য দেশের জাতীয় পতাকাকে কাজে লাগাচ্ছে। মেকি জাতীয়তাবাদের মুখোশ লাগিয়ে ঘরে ঘরে পতাকা বিলি করছে। চাকরি দিতে পারছে না, খেতে দিতে পারছে না, মূল্যবৃদ্ধির ঠেলায় মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত আর ওরা দেশের মানুষকে জাতীয়তাবোধের পাঠ শেখাতে আসছে। আসলে এসবই ওদের চিহ্নিতকরণ রাজনীতির অঙ্গ।”
সিপিএম এর জেলা কমিটির সদস্য তথা এসএফআইয়ের জেলা কমিটির সম্পাদক অনির্বাণ রায় চৌধুরী বলেন,” যে দলটা কিছুদিন আগে পর্যন্তও নিজেদের সদর দপ্তরে দেশের জাতীয় পতাকা তুলতো না। তিন রঙের এই পতাকাকে অশুভ বলে মানতো। তারা আর দেশের জাতীয় পতাকার গুরুত্ব, মর্যাদা কতটুকু দেবে। তাদের এই জাতীয় পতাকা বিলির কর্মসূচি আসলে মেকি দেশাত্মবোধের অঙ্গ। জাতীয় পতাকাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার একটা অপচেষ্টা মাত্র।”
জেলা যুব কংগ্রেসের সভাপতি গৌরব সমাদ্দার বলেন,” দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই কোনোদিন নিজের বাড়িতে জাতীয় পতাকা তোলেননি। তিনি আবার দেশের মানুষকে জাতীয়তাবোধের জ্ঞান দিতে যাচ্ছেন। এরা দেশের জাতীয় পতাকার গুরুত্ব, মর্যাদা কিছুই জানেনা। মোদীও জানেনা। যেমন রামের ইতিহাস না জেনে শুধু রাম রাম করে ওরা, তেমনই ওরা দেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাস, গুরুত্ব বোঝে না। তাই জাতীয় পতাকার অবমাননা ওরা করবে না তো কে করবে। ঘরে ঘরে পতাকা বিলি কর্মসূচি সবটাই বিজেপির রাজনৈতিক গিমিক।”
জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগ প্রসঙ্গে বিজেপির জেলা সহ সভাপতি শ্যামল রায় বলেন,” এটা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। দেশের স্বাধীনতার ৭৫বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মস্তিষ্ক প্রসূত ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ এর একটা অঙ্গ। যত বেশি মানুষের কাছে দেশের জাতীয় পতাকা পৌঁছে দিয়ে এই ৭৫বছর পূর্তি কে স্মরণীয় করে রাখা যায় তারই জন্য এই উদ্যোগ। তবে যারা এই পতাকা প্রচুর পরিমাণে তৈরি করেছে তাদের তরফ থেকে কিছু পতাকা ত্রুটিপূর্ণ ভাবে তৈরি হয়েছে। আমরা ত্রুটিপূর্ণ পতাকাগুলোকে বেছে বাতিল করে সঠিক পতাকাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া চেষ্টা করছি। তবে হতে পারে তারমধ্যেও কিছু পতাকায় সমস্যা দেখা গেছে। সেগুলো আমাদের ফেরত দিয়ে ভালো পতাকা নিয়ে নিতে পারেন নাগরিকরা। এর মধ্যে কোনো বিতর্ক আসতে পারেনা। বরং আমাদের চারপাশে অনেক রাষ্ট্রদ্রোহী মানুষ বসবাস করছে, যাদের চিহ্নিতকরণ করা দরকার।”
অন্যদিকে জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র প্রসেনজিৎ দাস এই প্রসঙ্গে বলেন,” জাতীয় পতাকা বিলি করছে করুক। অনেক মানুষের কাছে আজও দেশের জাতীয় পতাকা কেনার টাকা টুকু নেই। ওরা তো শুধুই দেশবাসীকে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব উপহার দিয়ে চলেছে। তাই বিনা পয়সায় পতাকা দিচ্ছে দিক। কিন্তু দেশের পতাকাকে অন্তত গেরুয়াকরণের বাইরে রেখে যা করার করুক। কারণ জাতীয় পতাকার মর্যাদা সম্পর্কে ওদের প্রধানমন্ত্রী থেকে নিচুতলার একজন কর্মীর কারুরই সঠিক জ্ঞান নেই। তাই জাতীয় পতাকা বিলির পর যদি সেই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়ে থাকে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’