বর্ধমানের এই অবস্থা কেন এমন হল? এক বর্ধমানির ভাবনা

Souris  Dey

Souris Dey

সর্বজিৎ যশ, বর্ধমান: বর্ধমান শহরের তাপমাত্রার পারদ সর্বকালীন রেকর্ড ছুঁয়েছে। এই মুহূর্তে থর বা সাহারা মরুভূমির তাপমাত্রা বর্ধমানের থেকে অনেক কম। কিন্তু কয়েকবছর আগেও তো বর্ধমান শহরে গ্রীষ্মের এই প্রকোপ অনুভব হতো না। তাহলে কেন এমন হল?

বিজ্ঞাপন

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বর্ধমান শহর উত্তরে লক্ষ্মীপুর থেকে দক্ষিণে বীরহাটা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই শহরের কাঞ্চন নগর থেকে গোলাপবাগ পর্যন্ত ছিল বিপুল পরিমাণে গাছপালা। শহরের ভিতরেও বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট বাগান ছিল। আমাদের পাড়াপুকুরেও ছিল বেশ কিছু বাগান। এখনো নামগুলো রয়ে গেছে, এখনো কোনো বাড়িকে বলা হয় ‘বাগান বাড়ি’। ফটিক বাবুর বাগান তো বিখ্যাত ছিল। ছিল চন্দ্রচূড় মুখার্জির বাগান, প্যারীচরণ মিত্রের বাগান। বর্তমানে সবই বিলুপ্ত। গোটা শহরটা ধীরে ধীরে ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাগানবাড়ি গুলিতে উঠেছে বহুতল ভবন। কোথাও ৮ তলা  তো কোথাও ১০ তলা বিল্ডিং।

অন্য একটি সমস্যা হল, শহরের পুরো এলাকাটাই বর্তমানে হয় পিচ, নাহলে ঢালাই দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে শহরের কোথাও মৃত্তিকা ভূমি দেখা যায় না। বৃষ্টি হলে সেই জল মাটির তলায় যেতে পারে না। বাঁধানো ড্রেনের মাধ্যমে বাঁকা হয়ে দামোদরে চলে যায়। ফলে, মাটির তলা থেকে যায় শুকনো, দিন দিন শুকনো হয়ে যাওয়া মাটি হয়ে উঠছে আরো গরম। কিন্তু তা ঠান্ডা হওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ মাটির তলায় জল যাওয়ার কোন ব্যবস্থা এই শহরে আমরা অবশিষ্ট রাখিনি। আমরা যখন ছোট ছিলাম বীরহাটা থেকে গাংপুর পর্যন্ত দুদিকে রাস্তায় বড় বড় গাছ ছিল, বর্ধমান শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছিল বড় বড় গাছ। গোলাপবাগ চত্বর তো পুরো জঙ্গলের মতো ছিল। মাঝখানের রমনা বাগানের পুকুর, তার চারিদিকে প্রচুর গাছ। সেসব দিন হারিয়েছে। এখন বিরহাটা থেকে গোলাপবাগ, কার্জন গেট থেকে কাঞ্চননগর সব জায়গাতেই বহুতলের রমরমা।

কয়েক বছর আগে বীরহাটা থেকে গাংপুর পর্যন্ত ত্রিফলা লাইট লাগাতে গিয়ে জি টি রোডের দুধারের বিপুল পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছিল, কথা ছিল পরে আবার গাছ লাগানো হবে, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে ত্রিফলা লাইটগুলোও পুনরায় তুলে ফেলা হলো এবং তিনকোনিয়াতে ডাম্প করে রাখা হলো।
বর্ধমান এখন প্রোমোটারির ভালো ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। কলকাতার শ্যামবাজারের থেকে বর্ধমানের ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেশি। ব্যবসা যারা করছে তাতে আমার অসুবিধা নেই, কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে বর্ধমান শহরে কোন সবুজ আর বেঁচে থাকছে না। কেউই ভাবছে না এই শহরটার ভবিষ্যতের কথা। কলকাতা শহরে কিন্তু ময়দানকে কেন্দ্র করে একটা বিরাট অঞ্চল সবুজ রাখাটা আইনত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমনকি সল্টলেকের মতন জায়গাতেও করুণাময়ীর পাশে পুকুরসহ বিরাট অঞ্চল সবুজ রাখা হয়েছে। কিন্তু বর্ধমান শহরে না আছে কোন হেরিটেজ কমিটি, না আছে কোন আইন। যার ফলে, কোন পুরনো বাড়ি-পুকুর-বাগান আর রক্ষা করা যাচ্ছে না। এরপর আর কোন কিছু রক্ষা করে যাবে বলেও মনে হচ্ছে না।

এবছরের প্রচন্ড গরম বুঝিয়ে দিচ্ছে যথেচ্ছ হারে গাছ কাটার ফল কি ! বর্ধমান শহরে গাছ লাগানোর খুবই প্রয়োজন। আশির দশকের প্রথম দিকে যখন প্রথম সরকারিভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু হয় তখন আমাদের স্কুল থেকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গোলাপবাগের বন বিভাগে। সেখান থেকে প্রত্যেককে গাছ দেওয়া হয়েছিল, সেইসব গাছ কিছু স্কুলে নিয়ে এসে লাগিয়েছিলাম আর কিছু বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। বর্তমানে গাছ লাগানোর জন্য জোর প্রচার হয় কখনো ফেসবুকে কখনো সরকারিভাবে ফ্লেক্স এর মাধ্যমে । কিন্তু বাস্তবে গাছ লাগানো হয় কি? যদিও বা কোন ব্যক্তি বা সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নেয়, সেখানে দেখা যায় গাছ লাগানোর দিন কিছু ছবি তোলা, কিছু খবর করার উপর যতটা জোর দেওয়া হয়, গাছগুলোর পরিচর্যার ক্ষেত্রে ততটা জোর দেওয়া হয় না। ফলে গাছগুলি অকালেই মরে যায়। স্বাভাবিকভাবেই বৃক্ষরোপনের মূল উদ্দেশ্য পরবর্তীতে সাধিত হয় না।

এইভাবে চলতে থাকলে বর্ধমান শহর ধীরে ধীরে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। যে ধরনের তাপপ্রবাহ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা প্রাণান্তকর প্রমাণিত হচ্ছে। বেলা দশটার পর রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে চালু বাসগুলি ফাঁকা, যাত্রী নেই। ফলে তাদেরও বিরাট পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের জোর দিতে হবে বৃক্ষরোপনে। প্রচারের কথা বলছি না, বাস্তব বৃক্ষরোপনের দিকে জোর দিতে হবে। শহরের কিছু জায়গা কে নির্দিষ্ট করতে হবে সবুজের জন্য, যেখানে শুধুই গাছ লাগানো থাকবে। সেই জায়গাকে কোন ধরনের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। জেলাশাসক অফিসের সামনের মাঠটি এক সময় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির কথা শুনেছিলাম, বলা হয়েছিল চারিদিকের অফিসে বিভিন্ন কাজে আসা মানুষ এখানে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারবে। তাই ভাঙ্গা হয়েছিল দেড় শতাধিক বছরের প্রাচীন ভবনটি। যা রেকর্ড রুম নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি গাড়ি স্ট্যান্ড হয়ে গেছে। এইভাবে সব জায়গাকেই যদি আমরা ব্যবসায়িক কাজে লাগাতে থাকি তাহলে গাছ থাকবে কি করে? লোভ যদি আমরা কমাতে না পারি, তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত। কারণ কথাতেই আছে ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’

আরো পড়ুন