ফোকাস বেঙ্গল ডেস্ক,জামালপুর: দুই পুত্রের মা রেখা চট্টোপাধ্যায়। বয়স ৭০ পেরিয়েছে। বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার পাঁচড়া গ্রামে। স্বামী গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় (৯৩) কয়েক মাস আগে মারা গিয়েছেন। পেনশেনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে তাঁর আধার কার্ড জমা দিতে গিয়ে রেখা দেবী জানতে পারলেন তিনি মহিলা নন, আধার অনুযায়ী পুরুষ। আর এহেন আশ্চর্য্য কান্ডে বৃদ্ধ বয়সে রীতিমত বিপাকে পড়েছেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই গৃহবধূ।
শুধু তাইই নয়, রেখা দেবীর দুই ছেলে অভিযোগ করেছেন, আধার দপ্তরের এই ভুলে তাঁর মায়ের কার্যত সম্মানহানি হয়েছে, তাঁকে অপমান করা হয়েছে। একজন মহিলা কি করে আধার কার্ডে পুরুষ হয়ে যায়! আর এই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে মা কে। আটকে গিয়েছে পেনশন। হতে হচ্ছে হয়রান। রেখা দেবীর স্বামী গুরুদাস বাবু স্কুল শিক্ষক ছিলেন। রেখাদেবীর দুই পুত্র রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় ও উদয়শংকর চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। এইরকম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ রেখাদেবীকে কোন যুক্তিতে আধার কার্ডে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হল তার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দারা। তারা এই ঘটনার জন্য নবগ্রাম পোস্ট অফিসে আধার কার্ড তৈরির দায়িত্বে থাকা লোকজনকেই দায়ী করেছেন।
কেন হল এই সমস্যা? রেখাদেবী জানিয়েছেন, আধার কার্ড বাধ্যতা মূলক হওয়ার পর নিজের আধার কার্ড করানোর জন্য তিনি সমস্ত নথিপত্র নিয়ে স্থানীয় নবগ্রাম পোস্ট অফিসে যান। সেখানে নির্দিষ্ট আবেদন পত্র পূরণ করে ও নির্ধারিত মূল্য জমা দিয়ে তিনি সমস্ত প্রক্রিয়া সেরে আসেন। এরপর ডাকযোগে তাঁর বাড়িতে আধার কার্ড আসে। রেখাদেবী বলেন, ওই আধার কার্ড হাতে নিয়ে দেখতেই তাঁর চোখ কপালে ওঠে। তিনি দেখেন,আধার কার্ডে তাঁর নাম ঠিকানা সব ঠিক থাকলেও তাঁকে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর দাবি, এরজন্য শুধু তার সম্মানহানি হয় নি, তাঁকে নানা অসুবিধার মধ্যেও পড়তে হচ্ছে। রেখাদেবীর কথায়,স্বামী মারা যাবার পর স্ত্রী হিসাবে তিনি যেহেতু পেনশন পাবার যোগ্য তাই সরকারী দপ্তরে তাঁর নিজের নথিপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে আধার কার্ডে তাঁকে পুরুষ বলে উল্লেখ থাকাটা।
এটা সংশোধনের জন্য সম্প্রতি তিনি নবগ্রাম পোস্ট অফিসে যান। তিনি যে মহিলা সেই সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র জমা দিয়ে পুণরায় যাবতীয় প্রক্রিয়া সেরে আসেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও আধার কার্ডে তাঁর আর পুরুষ থেকে মহিলা হয়ে ওঠা হয় না। নতুন যে আধার কার্ড ডাক মারফৎ তাঁর বাড়িতে এসেছে সেটিতেও একই ভাবে তাঁকে পুরুষ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। কি কারণে এই অভব্যতা? কেনই বা তাঁকে এইভাবে হয়রান করা হচ্ছে, তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না বলে রেখাদেবী জানিয়েছেন। তাঁর কথায় সত্তর বছর বয়সে তাঁকে যে নারী সেটা তাঁকে প্রমাণ করতে হচ্ছে, প্রমাণ দিয়েও মিলছে না নারীর পরিচয়। কি অদ্ভুত কর্মসংস্কৃতি অধার দপ্তরের!
গ্রামবাসী প্রেমনাথ ঘোষাল বলেন, ‘ভারতীয় নাগরিকের অন্যতম দুটি পরিচয় পত্র হল প্যান ও আধার কার্ড। আয়কর দফতর প্যানের সঙ্গে আধার লিঙ্ক করাটা বাধ্যতামূলক করেছে। এর জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে।প্রেমনাথ ঘোষালের অভিযোগ, এতকিছু সত্ত্বেও সঠিক আধার কার্ড পেতে এখনও দেশের প্রবীন নাগরিকদেরও হয়রান হতে হচ্ছে। এটা মানা যায় না।’
প্রতিবেশী বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘আমি রেখাদেবীকে জেঠিমা সম্বোধন করি। প্রথমবার যখন জেঠিমা হাতে আধার কার্ড পান তখনই দেখেন আধারে তাঁকে মহিলার পরিবর্তে পুরুষ করে দেওয়া হয়েছে। এই জন্য জেঠিমাকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল। তাই আধারের ওই ভুল সংশোধনের জন্য মাস দুই আগে তিনি রেখাদেবীকে টোটোয় চাপিয়ে নিয়ে নবগ্রাম পোস্ট অফিসে যান। রেখাদেবী যে মহিলা সেই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রমান ও ৫০ টাকা সংশোধনী ফিজ পোস্ট অফিসে জমা দিয়ে সব প্রক্রিয়া সেরে আসেন। ডাক বিভাগ থেকে বলা হয় চিন্তার কিছু নেই। ভুল সংশোধন হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন রেখাদেবীর ঠিকানায় নতুন আধার কার্ড আসে তখন দেখা যায় সেই একই ভুল রয়েই গেছে। এবারও আধারে রেখাদেবীকে পুরুষ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।’
রেখাদেবীর বড় ছেলে রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমার মা দেশের একজন প্রবীণা নাগরিক। তা জেনেও আধার কার্ডে আমার মা কে পুরুষ বলে উল্লেখ করাটা শুধু অভব্যতাই নয়, অসম্মানেরও বটে। এমনকি এইসব করে একজন প্রবীণা নাগরিককে হয়রানও করা হচ্ছে। প্রবীণ নাগরিকদের সঙ্গে এমন অভব্যতা ও হয়রানী আইনি পথে বন্ধের বিষয়ে রবিশংকর বাবুর চিন্তাভাবনা করছেন বলে জানা গিয়েছে।’
এই বিষয়ে নবগ্রাম পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মাধুরী টুডুর সাফাই,’এই ভুলের জন্য আমাদের তো কিছু করার নেই। ডাক বিভাগ এক্ষেত্রে এজেন্সি হিসাবে কাজ করে মাত্র। কেন বার বার ওই বৃদ্ধার আধার কার্ডে এমন ভুল হচ্ছে সেটা আধার দপ্তরই বলতে পারবে।’ নবগ্রাম পোস্ট অফিসে বসে উত্তম ঘোষ নামে যে ব্যক্তি আধারের কাজ করেন তাঁর সাফাই, ‘পুরানো এজেন্সি এইসব ভুল করে গেছে। এই ভুল সংশোধনের জন্য রেখাদেবীকে আরো একবার পোস্ট অফিসে এসে সংশোধন প্রক্রিয়া সেরে যেতে হবে।’ তবে এবার রেখা দেবীর আধার কার্ড ঠিক না হলে পরিবারের পক্ষ থেকে যে এবার আইনের আশ্রয় নেওয়া হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন তাঁর ছেলে রবিশংকর চট্টোপাধ্যায়।